সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আপনাদের সাথে আলোচনা করলাম ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট :
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির ধারাবাহিক অগ্ৰগতি ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ সময়কালে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। সেই সময় কোনোরকম সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়।
বি. বি. মিশ্র ব্রিটিশ ভারতে সরকারি চাকুরিজীবী, এজেন্ট, বণিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক প্রভৃতিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতায় নিয়ে এসেছেন এবং উদ্ভবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন, যথা- 1. ভূমিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি 2. শিল্পজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও 3. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্রভাগে ছিল বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সর্বপ্রথম ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় বাঙালি মধ্যবিত্তদের কথা বলা হয়। এই পত্রিকায় বাংলায় মধ্যবিত্তদের উত্থানের কারণ সম্পর্কে উল্লিখিত করা হয়েছে। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বা কারণগুলি আলোচনা করা হল-
১. সরকারি কর্মচারী : ভারতবর্ষে প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক প্রসারের সূত্রে এদেশে এক বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল যে, বিলেত থেকে তা আনা কোনোমতে সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনের উচ্চপদগুলিতে ব্রিটিশরা নিযুক্ত হলেও নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক চাকরির পদে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা সেই সুযোগ পেয়ে যায় নিযুক্ত হওয়ার। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল এই ভারতীয় কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
২. করণিকের কার্য : ব্রিটিশরা ভারতে তাদের শাসনকার্য প্রতিষ্ঠিত করার পর এদেশে অনেক স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থাপন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে করণিক পদে অনেক সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। সরকারি বেতনভুক্ত এই নিম্নবর্গের করণি কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৩. আইনজীবী : ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা অধিকহারে বেড়ে যায়। সাম্রাজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের আইন এবং বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বহু ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইনের পদ গ্রহণ করে। ব্রিটিশ-ভারতের আদালতগুলিতে আমলা, উকিল, কেরানি, মোক্তার, মুহুরি ও অন্যান্য বিভিন্ন কাজে শিক্ষিত ভারতীয়রা অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এই পেশায় প্রবেশ করে তাদের আর্থিক উন্নতি ঘটে। শিক্ষিত ও সচ্ছল এই ভারতীয় সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে পরিচয় পায়।
৪. সামরিক বিভাগের কর্মী : ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্রমাগত প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার এদেশে তাদের বিশাল সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। সামরিক বিভাগের উঁচুপদগুলি ইংরেজদের জন্যসংরক্ষিত হলেও নিম্ন পদগুলিতে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয় নিযুক্ত হয়। সরকারি বেতনভুক্ত সচ্ছল এই কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতায় আসে।
৫. ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগী : ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে কিছু জমিদার বা ভূস্বামী শ্রেণির প্রাধান্য ছিল। তারা প্রধানত প্রজাদের কাছ থেকে কর সংগ্ৰহ করত। ভূস্বামীর পক্ষ থেকে প্রজার কাছ থেকে কর আদায়ের কাজটি করত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির বিপুল মানুষ। বিপুল অর্থের অধিকারী এই জমিদার-ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ইংরেজদের অনুগত শ্রেণি হিসেবে নিজেদের পেশা ও উপার্জনকে সুনিশ্চিত করেছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণেও এগিয়ে এসেছিল। এই শ্রেণিও মধ্যবিত্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৬. ব্যবসায়ী : ইংরেজরা ভারতে এসেছিল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও ব্যক্তিগত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ভারতের দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জে প্রবেশ করে। ক্রমে তাদের বাণিজ্য বাড়তে থাকে। এই বিশালাকার বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রচুর কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিরা তাদের বাণিজ্যিক কাজকর্ম সচল রাখতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয়কে বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করে। বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত এসব ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মর্যাদা পায়।
৭. শিল্পকার্য : ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্পের ব্যপক বিস্তার ঘটে। লৌহ-ইস্পাত, কয়লা, ইঞ্জিনিয়ারিং, বস্ত্র, পাট, চা, কাগজ,কফি, চিনি প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ হয়। শিল্পকারখানাগুলির কার্য পরিচালনার জন্য বহু শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। শিল্পের কাজে নিযুক্ত এসকল শিক্ষিত ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম দাবিদার।
৮. মহাজন : ব্রিটিশ সরকার এদেশে চিরস্থায়ী, মহলওয়ারি, রায়তওয়ারি প্রভৃতি ভূমি বন্দোবস্ত চালু করলে ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের রাজস্বের চাপে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। নগদ কর আদায়ের জন্য কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী এই মহাজন শ্রেণি ভারতীয় মধ্যবিত্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মূল্যায়ন : ইংরেজ আমলে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা সংখ্যায় খুবই স্বপ্ল হলেও দেশের সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণিই মূলত ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিল। আবার উনিশ শতকে বাংলায় যে, ‘নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তার অগ্রভাগে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান।
আরও নজর রাখুন : |