সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আলোচনা করা হয়েছে ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে এবং ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্য, আবিষ্কার ও ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কিত নানা তথ্য সম্পর্কে।
ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে ধারণা :
ব্যাকটেরিয়া হল জীবজগতের অন্তর্গত এক ক্ষুদ্রতম আণুবীক্ষণিক প্রোক্যারিওটিক জীবাণু। ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীর সবজায়গায় বিরাজমান। ব্যাকটেরিয়া কোশে সুগঠিত নিউক্লিয়াস, পর্দাবেষ্টিত কোশ-অঙ্গাণু না থাকায় এবং রাইবোজোম 70S প্রকৃতির হওয়ায় ব্যাকটেরিয়াকে প্রোক্যারিওট বলা হয়। ব্যাকটেরিয়ার দেহে কোশপ্রাচীর থাকে, ব্যাকটেরিয়া ভিটামিন সংশ্লেষে সক্ষম এবং কিছু ব্যাকটেরিয়ার দেহে ক্লোরোফিল থাকায় ব্যাকটেরিয়াকে উদ্ভিদ বলে মনে করা হয়। 1676 খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডের এক অধিবাসী A.V. লিউয়েনহক এক ক্ষুদ্র দণ্ডাকার প্রাণীর বিবরণ দেন। 1773 খ্রিস্টাব্দে ড্যানিশ বিজ্ঞানী মুলার ওই দণ্ডাকার প্রাণীকে ব্যাসিলি নামে অভিহিত করেন। 1828 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী এহরেনবার্গ প্রথম এদের ব্যাকটেরিয়া নামকরণ করেন।
ব্যাকটেরিয়ার সংজ্ঞা :
আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত, কোশপ্রাচীর সমন্বিত, এককোশী, ক্ষুদ্রতম, সরল প্রকৃতির আণুবীক্ষণিক জীবাণুদের বলা হয় ব্যাকটেরিয়া।
ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক :
বিজ্ঞানী লিউয়েনহক (১৬৭৬) : নিজের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সর্বপ্রথম জীবাণুর অস্তিত্ব পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার নাম দেন, ‘অতিক্ষুদ্র দণ্ডাকার প্রাণী’।
বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (১৮৬৪) ও রবার্ট কক (১৮৬৩) : কলেরা, যক্ষ্মা, এই রোগগুলি যে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত তা প্রমাণ করেন।
বিজ্ঞানী এহরেনবার্গ (১৮২৮) : এই বিজ্ঞানী প্রথম ‘ব্যাকটেরিয়া’ নামকরণ করেন।
বিজ্ঞানী জিন্ডার ও লেডারবার্গ (১৯৫২) : এই বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়ার ট্রান্সডাকশন পদ্ধতির আবিষ্কারক।
বিজ্ঞানী F. J Cohn (1854) : এই বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়াকে উদ্ভিদ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করেন।
বিজ্ঞানী স্যাডিলট : এই বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়াকে ‘মাইক্রোবস্’ অ্যাখ্যা দেন।
বিজ্ঞানী মারি : এই বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়াকে প্রোক্যারিওটার অন্তর্ভুক্ত করেন।
পড়ুন : ফুল কাকে বলে এবং ফুলের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ ও বিভিন্ন ফুলের বিজ্ঞানসম্মত নাম ?
ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্য :
ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
১. ব্যাকটেরিয়া কোশীয় জীবদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্রতম এবং সরল আণুবীক্ষণিক জীবাণু। এদের ব্যাস 3µm-এর কম।
২. ব্যাকটেরিয়ার প্রোটোপ্লাজম আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত, অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয়পর্দা, নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়জালক থাকে না। কেবল একটি প্যাঁচানো দ্বিতন্ত্রী DNA তত্ত্ব থাকে। সেজন্য ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়াসকে নিউক্লিওয়েড বা জেনোফোর বা নিউক্লিয় বস্তু বলে।
৩. প্রোটোপ্লাজমে কেবল রাইবোজোম (70S) ও মেসোজোম থাকে। পর্দাবৃত কোনো কোশ-অঙ্গাণু থাকে না।
৪. ব্যাকটেরিয়া কোশে কোশপর্দার বাইরে একটি সুগঠিত কোশপ্রাচীর বর্তমান, যার প্রধান উপাদান মিউকোপেপটাইড বা পেপটাইডোগ্লাইক্যান।
৫. অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া পরভোজী, কিছু ব্যাকটেরিয়া স্বভোজী।
৬. স্বভোজী ব্যাকটেরিয়ার দেহে বিভিন্ন সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জক, যেমন-ব্যাকটেরিওক্লোরোফিল, ব্যাকটেরিওভিরিডিন বা ক্লোরোবিয়াম ক্লোরোফিল এবং ক্যারোটিনয়েড উপস্থিত।
৭. ব্যাকটেরিয়া মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এবং অনুপস্থিতিতে শ্বসন ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
৮. এরা 170°C থেকে 80°C পর্যন্ত তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে।
৯. ক্রোমোজোম না থাকায় ব্যাকটেরিয়ার মাইটোসিস ও মিয়োসিস কোশবিভাজন ঘটে না।
১০. ব্যাকটেরিয়া অঙ্গজ, অযৌন ও যৌন জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
১১. কতিপয় ব্যাকটেরিয়া ভিটামিন সংশ্লেষ করতে পারে।
১২. এরা অজৈব লবণ জারিত করে শক্তি সংগ্রহ করে।
১৩. এরা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
১৪. ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যালকোহল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
১৫. ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের নানান রোগ সৃষ্টি করে।
ব্যাকটেরিয়ার আয়তন :
কোশযুক্ত জীবেদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া কোশই ক্ষুদ্রতম। ক্ষুদ্রতম ব্যাকটেরিয়া কোশ ফুল Dialister preumosintes, মানুষের শ্বাসনালিতে রোগ সৃষ্টি করে। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া কোশ দৈর্ঘ্যে 0.5µm-5.0µm পর্যন্ত হয়। এছাড়াও গোলাকার, দণ্ডাকার, সর্পিলাকার ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাস বা দৈর্ঘ্য প্রস্থে যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। দণ্ডাকার ও সর্পিলাকার ব্যাকটেরিয়া দৈর্ঘ্যে বেশি-হয়। বৃহত্তম ব্যাকটেরিয়া হল Epulopiscium fishelsoni, একধরনের সামুদ্রিক মাছের অস্ত্রে মিথোজীবী রূপে বাস করে, এর দৈর্ঘ্য 600µm এবং ব্যাস 80µm।
ব্যাকটেরিয়ার বাসস্থান :
ব্যাকটেরিয়া জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই বিচরণ করে। সমুদ্র এবং মৃত্তিকার গভীরতম স্তরে ও উচ্চতম পর্বত শিখরেও এদের বিচরণ। এরা যেমন-170°C-এর নিম্ন তাপমাত্রায় বেঁচে থাকে তেমনি 75°-80°C এর উচ্চ তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকে। অক্সিজেনবিহীন পরিবেশেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। নীচে কতকগুলি ব্যাকটেরিয়ার বাসস্থান উল্লেখ করা হল-
১. বায়ুতে অবস্থান রত : ক্লসট্রিডিয়াম এর কয়েকটি প্রজাতি, ব্যাসিলাস সাবটিলিস, সারসিনা লিউটিয়া ইত্যাদি।
২. জলে অবস্থান রত : ভিব্রিও কোমা, সালমোনেলা টাইফি, ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি ইত্যাদি।
৩. মাটিতে অবস্থান রত : অ্যাজোটোব্যাকটার, নাইট্রোব্যাকটার, নাইট্রোসোমোনাস ইত্যাদি।
৪. শিম্বি গোত্রীয় উদ্ভিদের অর্বুদে অবস্থান রত : রাইজোবিয়াম।
৫. দুধে অবস্থান রত : ল্যাকটোব্যাসিলাস, স্ট্রেপটোকক্কাস ল্যাকটিস, এসচেরিচিয়া কোলাই ইত্যাদি।
৬. মাছ, মাংস ও ডিমে অবস্থান রত : সিউডোমোনাস ও প্রোটিয়াস এর বিভিন্ন প্রজাতি।
৭. উদ্ভিদদেহে রোগ সৃষ্টিকারী : জ্যান্থোমোনাস ওরাইজি, জ্যান্থোমোনাস সাইট্রি ইত্যাদি।
৮. মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী : ভিব্রিও কলেরি, সালমোনেলা টাইফোসা, মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস ইত্যাদি।