চিত্রা নামকরণে ছবির ইশারা আলোচনা করো

সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আলোচনা করলাম  চিত্রা নামকরণে ছবির ইশারা সম্পর্কে।

চিত্রা নামকরণে ছবির ইশারা :

কাব্যগ্রন্থের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রায় প্রথম দু’টি দশক জুড়ে রবীন্দ্র ভাবনার বৃত্তটি আবর্তিত হয়েছে মূলত দু’টি বিষয়কে ঘিরে। একটি চিত্র ও অপরটি সংগীত। ‘চিত্র এবং সংগীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ। চিত্র ভাবকে আকার দেয় এবং সংগীত ভাবকে গতিদান করে। চিত্র দেহ এবং সংগীত প্রাণ।” “সাহিত্যের তাৎপর্য” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ মন্তব্য করেছিলেন চিত্রার যুগের প্রায় দশ বছর পরে। 

কিন্তু ভাবনাটি প্রথম থেকেই ছিল এবং সম্ভবত শেষ পর্যন্তও ছিল। তাই ‘সন্ধ্যাসংগীত’ ‘প্রভাত সংগীত’; ‘কড়ি ও কোমল’ কিম্বা উত্তরকালের ‘পূরবী’, ‘শেষ সপ্তক’-এগুলো যেমন গানের ইঙ্গিত এনে দেয় তেমনি ”সোনার তরী’, ‘খেয়া’ ‘বিচিত্রিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ’ প্রদীপ’ ইত্যাদি নামগুলি এনে দেয় ছবির অভিব্যক্তি। ‘চিত্রা‘র প্রায় দশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ‘ছবি ও গান’-দুই ভাবনার সমন্বয়ী নাম।

‘চিত্রা’ নামকরণটি ছবির গোত্রের। গানের উপাদান এবং রয়েছে অনুষঙ্গ সচেতনভাবে বর্জন করবার প্রয়াস এর প্রকাশ বিষয়ক তথ্যের মধ্যে। দ্বিতীয় সংস্করণে নটি গান যুক্ত হয়েছিল চিত্রার কবিতার সঙ্গে পরে আবার বর্জন করা হয়েছিল সেগুলিকে অথচ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ভেবেছিলেন চিত্রা কাব্যের মূল ভাবটি রয়েছে এর একটি গানের চরণে “আমারে কর তোমার বীণা….”।

পড়ুন : পথের পাঁচালী উপন্যাসে সর্বজয়া চরিত্র ?

‘চয়নিকা’, ‘রাখী,’ ‘সঞ্চয়িতা’ প্রভৃতি কাব্যসংকলনের সাফল্যের পর ‘বিচিত্রা’ নামে রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধি স্থানীয় অনেক ধরনের রচনার একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ‘চিত্রা’, ‘বিচিত্রা’, ‘বিচিত্রিতা’ ইত্যাদি নামগুলি কবির পছন্দের তালিকার উপরের দিকেই ছিল চিরদিন। ‘চিত্রা’র নাম ‘বিচিত্রা’ হলেও খুব ক্ষতি ছিলনা, তবে ‘চিত্রা’ অনেকটা মেদহীন, লঘুছন্দের। তেমনি অজস্র ছবি আছে কবিতার পর কবিতায়। সেই ছবি গুলি নানা বর্ণে আর নানা অনুভবে বিচিত্রা।

‘চিত্রা’ নামের প্রথম ইঙ্গিতটি পাব কাব্যের প্রথমদিকে। ‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে/ তুমি বিচিত্ররূপিণী…….। সেই বিচিত্রের সন্ধান ‘চিত্রা’র কবিতায়। তার যে ছবি আঁকা হয়েছে, তার বৈভব কিছু আগেই আমরা দেখেছি সোনার তরীর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায়। সেই বিচিত্রা কবির কাছে কখনো ‘চঞ্চলগামিনী’, কখনও ‘অচপল দামিনী’ কিংবা ‘প্রশান্তহাসিনী’। তাঁর আনন্দোল্লাস পুষ্পকানন থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নীল আকাশে; তাঁর নূপুরের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, বাতাসে ভাসছে চুলের গন্ধ, তাঁর স্নিগ্ধ নীল চোখে সমুদ্রের গভীরতা, তার হাসি যেন প্রথম ঊষার আলো।

এমন চিত্রময়তার মধ্য দিয়ে যে কাব্যের সূচনা তার নাম ‘চিত্রা’ হওয়াই স্বাভাবিক। উষার রক্তিম আভা দিয়ে গড়া এই অন্তরবাসিনীর ছবিটি যখন এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই মুহূর্তে হয়তো বিহারীলালের সারদা প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত ছিলেন কবির মনে। আবার পরক্ষণেই, ফিরে আসে বঙ্গদেশের চিরচেনা ছবিগুলি- ‘অর্ধমগ্ন বালুচর/দূরে আছে পড়ি, যেন দীর্ঘ জলচর/ রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে’।

এমনি অজস্র ছবির সম্ভার রয়েছে চিত্রার কবিতায়। ‘জ্যোস্নাংরাত্রে’, ‘পূর্ণিমা’, ‘রাত্রে ও প্রভাতে’, ‘আবেদন’, ‘উর্বশী’, ‘দিনশেষে’, ‘বিজয়িনী’, ‘১৪০০ সাল’, ‘সিন্ধুপারে’ চিত্রার পরিচিত প্রায় সমস্ত কবিতাই যেন ছবির পরে ছবি গেঁথে গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে শ্রীসুকুমার সেন এর মন্তব্য- “চিত্রায়…..রূপকথার তুঙ্গ প্রাসাদ হইতে যেন সাধারণ জীবনের সমতল ভূমিতেঅবতরণ। 

সোনার তরীর ও চিত্রার কাহিনি কবিতাগুলি তুলনা করলে একথা স্পষ্ট বোঝা যায়। একটা সর্বব্যাপী প্রশান্তি প্রবাহে কবিচেতনা জীব ও জড় প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে, আর কবিভাবনা যেন জীবন স্রোতোবাহী জীবলীলায় চলৎচিত্রার্পিত হইয়াছে। এইখানেই কাব্যনামটির বিশেষ সার্থকতা।’

যে ব্যঞ্জনা কাব্যগ্রন্থের নামকরণে কাম্য, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তার অভাব ঘটেনি কোনোসময়ই। তবু বিশেষভাবে “চিত্রা”র কথা উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে সকল ছবি আর গানের জগৎ পর্যায়ক্রমে সঞ্চারিত হতো রবীন্দ্রমানসে। হয়তো গানের অধিকার সেখানে বেশি, কিন্তু ছবিও উপেক্ষিত ছিল না। “চিত্রা” তার প্রমাণ। 

অনেক পরে জীবনের শেষ দশকে এসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন এক তরুণ কবিকে যাঁর কবিতার “চিত্ররূপময়তা” মুগ্ধ করে কবিকে। সেই জীবনানন্দের কবিতারও মুখ্য সম্পদ তার ছবি। আপন আপন সময়ে, নিজেদের তারুণ্যের কালে দুজনেই চিত্রকে প্রধান করে তুলেছিলেন তাঁদের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি বিশেষ কালপর্বে সেই দায় পালন করে গেছে “চিত্রা”।

আরও একটি দিক থেকে “চিত্রা” নামটি অর্থবহ। তার ইঙ্গিত নিজেই দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় ১৬ বছর পরে ক্ষিতিমোহন সেন সহ কয়েকজন অনুরাগীর সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, “চিত্রা” এবং “জীবনদেবতা” সমার্থক ছিল কবির কাছে। অন্তরবাসিনী সেই অস্তিত্বকে নানা নামে সম্বোধিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কখন, কোন অলক্ষ্যে সে যে কবির চিত্রা ও হয়ে উঠেছে তা বোঝা গেল অনেক বছর পরে। কবির সাক্ষ্য: “সে সময়ে একটা ধারণা ধীরে ধীরে আসে যে, জীবনের ভাঙাগড়া আকস্মিক ব্যাপারাবলী মাত্র নহে সবটাতেই একটি শিল্পী হস্তস্পর্শ টের পাওয়া যায়। 

তারপর থেকে ক্রমাগতই তাকে দেখা যায়। এইরকম মানসিক অবস্থাতে নানাভাবে আমার ভাবকে প্রকাশ করিতে চাহিয়াছি। ‘সোনার তরী’-র শেষ দিকে ও ‘চিত্রা’য় যে ঐক্য দেখিতেছিলাম, তাহা আমার শাস্ত্রলব্ধ নহে। শাস্ত্রের দেবতাও তিনিই কিনা জানি না। তাই অন্য কাহারও নাম আমি দেই নাই। নিজের মনোমত “চিত্রা”, “জীবনদেবতা” প্রভৃতি নাম দিয়াছি।” দেশ-সাহিত্য সংখ্যা।

পড়ুন : পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গার চরিত্র ?

“চিত্রা” কাব্যগ্রন্থের প্রথম খণ্ডের কবিতা ‘চিত্রা’। প্রথম কবিতার নামে বা অন্য কোনো কবিতার নামে সমগ্র গ্রন্থের নামকরণ রবীন্দ্রসৃষ্টিতে একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু এখানে নাম-কবিতার গুরুত্ব তুলনায় বেশি। কবির জীবনদেবতাই “চিত্রা”; কবির “অন্তর্যামী” ও চিত্রা-ই। কবির নিজের স্বীকৃতিতেও তারই আভাস‌। “আমি অন্তরের খুব তীব্র অনুভূতিতে সবকিছু দেখিতেছিলাম। যত দৃশ্য, শ্রাব্য আর বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নহে। এখন সবই যেন একটি ঐক্য লাভ করিয়া উঠিতেছে। 

চিত্রকর যেন প্রথমে একটা একটা রঙ দেয় ও পরে ক্রমশ তাহাকে ক্ষয় করিয়া চিত্র ফুটাইয়া তোলে। জীবনেও প্রথমে ভালো মন্দ নানা রঙ আসে সে সবার এক-একটা রঙ লেপা দেখিয়া ভাবিয়া বুঝে না যে অর্থ কী? ক্রমশ সে স্বতন্ত্র রঙগুলি মূর্তি পরিগ্রহ করে।”

এমনি নানা রঙের ছবি হল “চিত্রা”। সে ছবি একদিকে যেমন বর্হিবিশ্বের অন্যদিকে কবির অন্তর্জগতের-উভয় দিকেই সে সত্য।

Leave a Comment