সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আমরা আলোচনা করলামচিত্রা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য মনস্কতা সম্পর্কে।
চিত্রা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য মনস্কতা :
যদিও রবীন্দ্রকাব্যে আগাগোড়াই সুন্দরকে অনুভব করবার প্রবণতা রয়েছে তবু ‘মানসী’ সোনার তরী চিত্রার যুগে সেই অনুভবের স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ‘চিত্রা’য় কবির সৌন্দর্যচেতনা এমন এক পূর্ণতা লাভ করেছে যা অত্যন্ত দুর্লভ। “চিত্রা’য় কবির এই অনুভব পূর্ববর্তী কাব্য ‘সোনার তরী’-এর ধারা বেয়েই এসেছে কিন্তু ভাবের যে ঐশ্বর্য ‘চিত্রা’-এর কবিতাগুলি লাভ করেছে তা সোনীর তরীতে নেই।
সোনার তরীকে যে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর সঙ্গে কবি পরিচিত ছিলেন সেই দিব্য বিভাময় সুন্দরীর ধ্যানে, তাঁর পূজায়, বন্দনায় চিত্রা মুখরিত। কিন্তু একটা স্বাতন্ত্র্য আছে, এতকাল তিনি বিশ্বসৌন্দর্যের মূলগত ভাবকে এক নারীমূর্তির মধ্যে আবদ্ধ দেখেছিলেন, এবার সেই আবরণ গেল খসে, সেই সৌন্দর্যের প্রতিমা এবার তিনি দেখতে পেলেন যে তা পৃথিবীর মধ্যে অধিষ্ঠিতা। সৌন্দর্যের আদিরূপ যা বস্তু নিরপেক্ষ ইন্দ্রিয়ভোগের অতীত এক ভাবময় প্রেরণা এই বোধ ‘চিত্রা’ তেই প্রথম কবির মধ্যে এল। সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে প্রেয়সী কল্পনার শেষ রশ্মি এখনও আছে তবে তা ম্লান এবং নতুন তত্ত্ব দ্বারা আবৃত।
‘চিত্রা’য় কবির সৌন্দর্যানুভব নানা কবিতায় নানাভাবে ধরা দিলেও বিশেষ কয়েকটি কবিতায় এই অনুভব স্পষ্টতর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেমন- “চিত্রা”, ‘ঊর্বশী’, ‘বিজয়িনী’, ‘আবেদন’, ‘জ্যোৎস্নারাত্রে’, ‘পূর্ণিমা’, ‘দিনশেষে’ ইত্যাদি।
‘পূর্ণিমা’ এবং ‘জ্যোৎস্নারাত্রে’ কবিতাদুটির অনুভূতি এবং পটভূমি গঠিত হয়েছে পদ্মাপারের কবির পল্লিজীবনের আনন্দ ও প্রকৃতির রূপকল্প দ্বারা। এই শান্তিময়, আনন্দময়, বিশ্বচেতনার সঙ্গে একাত্ম অনুভূতি কবি তাঁর কাব্যের মাধ্যমে প্রেয়সীর অর্থ করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন এই দুটি কবিতায়।
পড়ুন : চিত্রা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য মনস্কতা ?
জ্যোৎস্নারাত্রির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হল বিশ্বের লক্ষ্মী। কবিতার দরবারে প্রেমিকের নিঃসংকোচ অধিকারে আসতে পারেন নি, এসেছেন মাল্যকারের কুণ্ঠিত অনুগ্রহ প্রার্থনা নিয়ে। “পূর্ণিমা” কবিতায় কবি বিস্ময়বিমুগ্ধ, বিশ্বব্যাপী জ্যোৎস্নাপ্রবাহ এবং পূর্ণিমাকে কবি ‘অনন্তের অন্তরশায়িনী’ আখ্যা দিয়েছেন। ‘পূর্ণিমা’ বিশ্বব্যাপিনী লক্ষ্মীরূপে কবির হৃদয়ে বিশ্বচেতনার উদ্বোধন ঘটিয়েছে।
‘দিনশেষে’ হল ‘চিত্রা’ এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা। পরবর্তী “খেয়া”এর যুগের সাংকেতিকতার প্রথম আভাস আছে এই কবিতায়। সৌন্দর্য এ কবিতাতে কবির কাছে অনায়াসে ধরা দিয়েছে। এখানে আছে গোধূলিসন্ধ্যায় নতমুখী তরুণীর কংকণ ঝংকার, নিথর নীরবতা, মন্দিরের চূড়ার ত্রিশুলে অস্ত সূর্যের শেষরশ্মি আর দুর থেকে ভেসে আসা পূরবীর উদাস সুর। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ রচিত হয়েছে এই কাব্যে।
“বিজয়িনী” ও “আবেদন” কবিতা পরস্পরের খুব কাছাকাছি, বিশ্বজগতের অনন্ত সৌন্দর্য পরিবেশিত হয়েছে নারীতে। সেই নারী সর্বত্র বিজয়িনী এবং জগতের সমস্ত আবেদন তারই পদপ্রান্তে। দীন যে ভৃত্য, অকস্মাৎ তার চোখের উপর থেকে ক্ষুদ্রতার সমস্ত আবরণ খসে গেছে। বিশ্বের সৌন্দর্যকে অনুভব করার ক্ষমতা যেন জাগরিত তার হৃদয়ে। তার নিঃস্বার্থ সেই ভোগ, সেই সুন্দরের পূজা প্রকাশ পেয়েছে তার আবেদনে-
“আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর”।
‘আবেদন’ কবিতায় মানুষের ব্যথাবেদনা উপশমের দুরাকাঙ্খা থেকে কবি দূরে সরে গেছেন। মানসসুন্দরীকে রাণীরূপে কল্পনা করে বিশুদ্ধ সৌন্দর্যসেবায় একনিষ্ঠ ভৃত্য ভক্ত রূপে তিনি নিজে কল্পিত। রাজপ্রাসাদের বিপুল সৌন্দর্য রাজ উদ্যানের গন্ধস্পর্শ, রানীর প্রসাধন সৌন্দর্য ইত্যাদি অনুভবের মধ্যে ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার বিপরীত সুর ধ্বনিত। জীবনের পথে দুঃখবরণকারী যাত্রী এ কাব্যে রণশয্যাত্যাগী সৌন্দর্যাবেশমুগ্ধ মালঞ্চের মালাকরে পরিণত হয়েছেন।
“বিজয়িনী” কবিতাতেও বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের কথাই ব্যক্ত, যে সৌন্দর্যের অন্বেষণ কবির শুরু হয়েছিল মানসীর যুগ থেকে। চিত্রাতেও কবির মূল অন্বিষ্ট এই কামগন্ধহীন বিশুদ্ধ সুন্দরের বন্দনা। কবির ইন্দ্রিয়মোহের তাত্ত্বিক পরাজয় ঘোষিত হয়েছে এই ‘বিজয়িনী’ কবিতায়। একদিকে বিশ্বজগতের সমস্ত সৌন্দর্যের আশ্রয় ইন্দ্রিয়জ ভোগের অতীত সৌন্দর্যলক্ষ্মী অন্যদিকে পঞ্চশর হস্তে কামের দেবতা মদন।
শেষ পর্যন্ত মদনের পরাজয় এবং স্নানোত্থিতা সেই বিশ্বলক্ষ্মী যার সমস্ত শরীরের প্রতিটি অঙ্গে লাবণ্য এবং সৌন্দর্য উদ্ভাসিত তাঁর জয় ঘোষিত। স্নানোখিতা নারীর দেহসৌন্দর্য, সরোবর, শ্বেতহংস, অঙ্গভূষণ সমারহ এবং সর্বোপরী সমস্ত সৌন্দর্যের উপর দিয়ে এমন এক মধুর শীতল বাতাস সমস্ত কবিতায় প্রবাহিত যার ফলে সুন্দরীর দেহের প্রতিটি উন্নত অংশে মধ্যাহ্নের সূর্যলোকে ঝল্ল্সে ওঠা উগ্রতাকে কমনীয় শিশুসৌন্দর্য দিয়েছে।
“অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে’ ‘চিত্রা’ কবিতার বিচিত্ররূপিনী মানসসুন্দরীকে উদ্দেশ্য করে এই রকম পংক্তি রচনা কবির সৌন্দর্যমুগ্ধতার পরিচয়। কিম্বা কখন বলেন।
“মুখের নূপুর বাজিছে সুন্দর আকাশে,
অলকগন্ধ উড়িছে মন্দ বাতাসে।।”
তখন যে চঞ্চলাগামিনীর কথা এখৈ ব্যক্ত হয় একটু পরেই কবি তাকে অনুভব করেন তাঁর নিজের অন্তরে “তুমি অন্তরবাসিনী”।
অনন্ত প্রেমের জননী বিচিত্র বিভাময়ী দেবী নির্দিষ্ট রূপকের গণ্ডি পেরিয়ে এ কবিতায় বিচিত্র রশ্মি ছটার মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয়তা লাভ করেছে। বিশ্বসৌন্দর্যের প্রতি কবির অনুরাগ এইভাবে প্রকাশিত।
পড়ুন : পথের পাঁচালী উপন্যাসে সর্বজয়া চরিত্র ?
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনার শীর্ষস্থানীয় কবিতা “উর্বশী”, ‘চিত্রা’ তথা সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ছিল। স্বর্গের কল্পনার কবি কোন দীনতা অনুভব করেননি। কবির হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রেম ও সৌন্দর্যানুরাগ আদর্শায়িত ছিল তা রূপ নিয়েছে পৌরাণিক ঊর্বশীর আশ্রয়ে। রবীন্দ্র কবিকল্পনা, বিশ্বচেতনা অসীমকে সত্ত্বায় অনুভব রূপমুগ্ধতা এবং প্রেমাবেশ-ইত্যাদি যা কিছু উপাদান, সবই এই একটি কবিতায় সংহত হয়েছে।
এই ঊর্বশী মানুষের হৃদয়-সমুদ্র মন্থন হইতে জাগ্রত। তার এক হাতে আছে অতৃপ্তির বিষ অন্যহাতে রয়েছে তৃপ্তির অমৃত। তার শৈশব নেই, কৈশোর নেই, সে অনন্তযৌবনা মানবের হৃদয় সমুদ্রের রূপলক্ষ্মী। উর্বশীর কোনও বন্ধন নেই কামনা নেই আছে কেবল উদাসীন সৌন্দর্যের অপরূপ বিস্ময়। লৌকিক কোনও কর্মের অভ্যস্ততার মধ্যে যে ধরা দেয় না। অথচ তার মোহিনী সৌন্দর্যের কটাক্ষে বিশ্বজগৎ যৌবন চঞ্চল। মুনির ধ্যানের সমস্ত ফল অপহরণ করে সে অনায়াসে।
সমস্ত কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে সৌন্দর্যের কিরণ ঝলসে উঠেছে।
“ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল
শষ্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল
তব স্তনহার হাতে নভস্তলে খসি পড়ে তারা।”
ইত্যাদি বহু চরণ উদ্ধৃত করা যায়
মানসসুন্দরীর সত্ত্বার একটি অংশ ঊর্বশীতে আরোপিত হয়েছে। সৌন্দর্যের স্থান সমস্ত শুভ অশুভের ঊর্ধ্বে। মানবজীবনের কল্যান অকল্যানের সংকীর্ণতা তা বিচার্য নয়। এই তত্ত্বই ঊর্বশী কবিতাতে রয়েছে।