সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আলোচনা করা হলো সিন্ধুপারে রূপকথা আর অধিবাস্তব জগতে জীবনদেবতার সঙ্গ সম্পর্কে
সিন্ধুপারে রূপকথা আর অধিবাস্তব জগতে জীবনদেবতার সঙ্গ :
চিত্রার শেষ কবিতা সিন্ধুপারে আলোচনা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন “এটি রবীন্দ্রনাথের একমাত্র কবিতা, যেখানে কীটস অথবা কোলরিজের মতো তিনি চেয়েছিলেন ত্রাস ও রহস্যকে মেলাতে;”। রূপকথার আবরণ ও রোমান্টিকতা কবিতাটির প্রাণ। সুকুমার সেন ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে এ কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন- “কবিতাটি পড়িলে মনে হয় যেন রূপকের স্ফটিক পাত্রে রূপকথার উজ্জ্বল রস উছলিয়া পড়িতেছে।”
রূপকথা ও রহস্যময়তাকে সৃষ্টির উপাদান হিসেবে অনেক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকই ব্যবহার করেছেন। শেক্সস্পিয়র, কিট্স বা এঙ্গার এলান পো এর মতো রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। বরং তাঁর বেশ কিছু গল্প ও কবিতায় রোমান্স ও রূপকথার উপাদান আমাদের চমকিত করে। তবে নিছক রূপকথার গল্পকথা শিশু সাহিত্যে চলে। আসল কথা রূপকথার রূপকের আবরণে অভিপ্রেত বক্তব্য বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই কবি ও কবিতার সার্থকতা।
সেদিক থেকে সিন্ধুপারে কবিতায় যে রোমান্স ও রূপকথার জগৎ তৈরি হয়েছে তার পরিণতি কি নিতান্ত রোমান্টিক শিশু কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নাকি তার আবেদন আরো গভীরে রূপকথার জগৎ থেকে অন্তর্জগতের বাস্তবতায়? “সন্ধ্যাবেলা জ্বলত তেলের প্রদীপ তারই ক্ষীণ আলোয় মাদুরের উপর বসে বুড়ি দাসীর কাছে শুনতাম রূপকথা।”রূপকথার জগৎ এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কবি সত্তায় নিহিত হয়ে গিয়েছিল ছেলেবেলা থেকেই।
কিন্তু রূপকথার রোমান্টিকতা কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে নিশ্চয় নিতান্ত শিশু সাহিত্যের রূপকথার জগৎ হয়ে থাকতে পারে না। তাতে শিশুদের জন্য রচিত ‘শিশু’ বা শিশু ভোলানাথ’ কবিতা গ্রন্থই রচিত হোক না কেন। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর শিশুপাঠ্য গল্পে রূপকথা একান্তভাবে শিশুদের মনের রূপকথার জগত থেকেই সৃষ্ট বলে মনে করা হয়।ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’ সে দিক থেকে শিশুমনের রূপকথার রহস্য ও খোরাক জুগিয়েও রূঢ় বাস্তবতার বিপ্রতীপে এক বিকল্প জগত নির্মাণ করেছে।
পড়ুন : চিত্রা কাব্যগ্রন্থর জীবনদেবতা ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করো
বাস্তবের ঘেরাটোপের জাল ছিঁড়ে ফেলা সেই বাস্তাবতিশয়ী রূপকথার জগতকে বলা যায় ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা। অবশ্য এই ধরনের ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথের ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় থাকার কথা নয় এবং তা নেইও। ‘সিন্ধুপারে’ কবিতার আপাত রূপকথায় জগতের অন্তরালে রয়েছে কবির জীবন রহস্যের সন্ধান। এই জীবনরহস্য ‘চিত্রা’ পর্বে জীবনদেবতা ভাবনাকে ঘিরেই। আলোচনা সূত্রে আমরা লক্ষ্য করতে পারবো কিভাবে জীবন দেবতা ভাবনার বলয়টি ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় সম্পূর্ণতা পেয়েছে। এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক কবিতার পাঠে।
কবিতার শুরু শীত রাত্রির নিস্তব্ধ পরিবেশের একটি নিদ্রিত পুরীতে সুখ নিদ্রার ঘোরে মগ্ন কবির কথা দিয়ে। পরিবেশ বর্ণনাতে গা ছমছমে রহস্যময়তা এসেছে “ঝিল্লিমুখর রাতি নিদ্রার পুরী, নির্জন ঘর, নির্বাণ দীপ রাতি।” এমন সময় এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বাইরে থেকে সহসা কবিকে নাম ধরে কে যেন ডাকে। ‘তীক্ষ্ণ শানিত তীরের মতন’ সে স্বর কবির মর্মে গিয়ে বাজে। রোমাঞ্চকলেবর হয়ে দুরুদুরু বুকে বিছানা ছেড়ে বিরল বসনে কবি দুয়ার খুলে বাইরে এসে দাঁড়ান। দেখেন অবগুণ্ঠনে ঢাকা এক রমণীমূর্তি কালো ঘোড়ার সওয়ারি হয়ে বসে রয়েছেন।
ধূম্রবরণ অন্য একটি ঘোড়া বিরাজমান রয়েছে। রহস্যময়ী রমণীর অঙ্গুলী ইশারায় ‘মন্ত্রমুগ্ধ অচেতন সম কবি সেই ঘোড়ার চড়ে বসলেন। শুরু হল যাত্রা রূপকথার জগতে। বিদ্যুৎ বেগে ঘোড়া ছুটে চলে ‘লক্ষ্যবিহীন তীরের মত’। ঘোড়ার পা যেন মাটি স্পর্শ করে না, উড়ে নাকো ধূলিরেখা’। যেন রূপকথার তেপান্তর পেরিয়ে চলেছে ঘোড়া ‘মাঝে মাঝে যেন চেনা চেনা মতো মনে হয়, অভিভূত মন্ত্রমুগ্ধ কবির মনে তখন দ্বিধা “দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি? অথবা তরুর মূল?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল?” কবি শুধু মাঝে মাঝে চেয়ে দেখেন রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখ। প্রাণ যেন কেঁপে ওঠে। কবির মুখে ‘কথা নাহি ফুটে’। ভয়ে তিনি ‘ভুলে যান দেবতার নাম।
অবশেষে ঘোড়া এসে থামল এক নির্জন সমুদ্রতীরে। তখনও সকাল হয়নি ‘সাগরে না শুনি জলকলরব, না গাহে উষার পাখি।’ ঘোড়া থেকে নেমে সেই অবগুণ্ঠিতা কবিকে নিয়ে গমন করলেন গুহা প্রাসাদের অভ্যন্তরে। আশ্চর্য এই গুহা প্রাসাদ, আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের আশ্চর্য সৃষ্টির মতো। গায়ে তার চিত্রিত পাষাণ মূর্তি মাঝখানে চাঁদোয়া খাটানো মুক্তার ঝালর দেওয়া।
মাঝে একটি মণি পালঙ্ক অমল শয়ন পাতা। ধূপাধার থেকে ধূপের গন্ধ আসছে। সেখানে নেই কোনো প্রহরী, অথবা দাসদাসী। এমন সময় সেই নারী পালঙ্কের অমল শয্যায় বসলেন এবং কবিকেও পাশে বসালেন। ভয়ে রোমাঞ্চে কবির সর্ব শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল শোণিত প্রবাহে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান।
দশ দিকে বেজে উঠল বীণাবেণু। ঝরে পড়ল পুষ্পরেণু। দ্বিগুণ আভায় জ্বলে উঠল দীপের আলোক রশ্মি। আর সেই রমণীর মধুর উচ্চ হাসিতে সমস্ত গাম্ভীর্য যেন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তার পরে চলল বিবাহের আয়োজন। রমণী সোনার দণ্ড নিয়ে মাটিতে আঘাত করা মাত্রই চারিদিক শত শত শঙ্খ ধ্বনি বেজে উলু ধ্বনি উঠল। ব্রাহ্মণও উপস্থিত হলো ধানদুর্বা হাতে। তার পিছনে দুই সারি কিরাত নারীরা কেউ বা মালা, কেউ চামর, কেউ বা তীর্থজল নিয়ে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধ গণক লগ্নকালও ঘোষণা করলেন।
যেন রূপকথার বিবাহ বাসর। কবির সম্মতি অসম্মতির কোনো সুযোগ নেই। পুরোহিতের মন্ত্র পড়া শেষ হতেই “অজানিত বধু নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর/হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।”বিবাহ শেষ হল। এর পর বাসর ঘরের দৃশ্য। অনেক দীর্ঘ আঁধার কক্ষ পেরিয়ে অবশেষে কবি দেখলেন বাসর সজ্জা-‘কনকে রজত রতনে জড়িত বসন বিছানা কত- “মণিবেদিকার কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিত মতো।”
পড়ুন : চিত্রা নামকরণে ছবির ইশারা আলোচনা করো
সেই রমণী বসলেন সেই পাদপীঠে চরণ ছাড়িয়ে। আর এতক্ষণে কবি প্রথম কথা বললেন’সব দেখিলাম, তোমারে দেখিনে শুধু।’ সেই মুহূর্তেই চারিদিক থেকে শত ফোয়ারার যেন কৌতুক পরিহাস উচ্ছলিত হয়ে উঠল। দুই বাহু তুলে সেই রমণী এতক্ষণে তার অবগুণ্ঠন তুলে ধরে মধুর হাসি হেসে উঠলেন। আর তার পরেই কবির বিস্ময়-‘এখানেও তুমি জীবন দেবতা।’ কহিনু নয়ন জলে।”
রূপকথার অপরূপ রাজ্য থেকে কবি এ কোথায় এসে পড়লেন, রমণীর অবগুণ্ঠন তোলা পর্যন্ত কবিতাটির সর্বাঙ্গে ছিল রূপকথার অপরূপ আভা। কবির শেষ কথাটি বলার আগে পর্যন্ত কবিতাটি রূপকথার রহস্যময়তা মাত্র ছিল। অথচ শেষ পরিণতিতে কবিতাটি রূপকথার জগত থেকে কবির অন্তর্জগতের আর এক বাস্তবে এসে পড়েছে। ঠিক এরকম আকস্মিক পট পরিবর্তন কি আমরা আশা করেছিলাম? হয়তো না।
তাই এখানে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে- জীবনদেবতার স্বরূপ প্রকাশই যদি কবিতাটিতে কবির লক্ষ্য হয় তাহলে এত রহস্য- রূপকথার রোমান্সের আয়োজনের প্রয়োজন কী ছিল। সমালোচকদের কারো কারো কাছে এই পরিণতি ‘অতিনাটকীয়, অপ্রাকৃত-আতঙ্ক কণ্টকিত অন্তিম যবনিকা পাত।’ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই মন্তব্য করেছেন-“অবশ্য কবিকল্পনা ভাবাসঙ্গ উদ্বোধনে অসাধ্য-সাধন করিয়াছে কিন্তু আয়াস নির্মিত বেদীর সহিত উহার প্রতিষ্ঠিত প্রতিমার অসামঞ্জস্য কবির-অঘটন-ঘটন-পটীয়সী শক্তির দ্বারাও দূরীভূত হয় না।
আপাতভাবে সমালোচকের এই বক্তব্য হয়তো সঠিক। স্ফটিকের উজ্জ্বল পাত্রে রূপকথার রস যতখানি উচ্ছল হয়ে পড়েছে, সেই অপেক্ষায় কবিতাটির এমন আকস্মিক তাত্ত্বিক পরিণতি কিছুটা আরোপিত মনে হয়। কিন্তু এটাও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে যে, রূপকথার রহস্যময় গল্প কথা দিয়েই যদি এ কবিতা শেয় হতো তাহলে তা হয়ে উঠত নিছক ছেলে ভোলানো রূপকথার রোমান্টিককতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এই সাধারণ পরিণতিও আমাদের আশা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বলেই নিছক রোমান্টিক রসপরিণতিতে কবিতাটি সমাপ্ত হয়ে যায়নি। কবির অন্তর্জগতের বাস্তবতা ছুঁয়ে জীবনদেবতার ভাবনাকে পূর্ণতা দিয়েগেছে।
যে নবীন জীবনেও নূতন বিবাহে আবদ্ধ হবার প্রার্থনা কবি জীবনদেবতার কাছে জানিয়েছেন, সেই পরজনমের সম্পর্কের বৃত্তটিই সম্পূর্ণ হয়েছে ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায়। ইহজীবনের পালা অতিবাহিত করে নবজীবনের মধ্যে দিয়ে কবি তাঁর জীবনদেবতাকে পেয়েছেন। এই যে আদি অন্তহীন আত্মিক অস্তিত্ব কবির পূর্ব-জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর পরপারেও বিস্তৃত হয়েছে এই পাওয়ার মধ্যে দিয়েই যেন কবির আত্মিক-অস্তিত্বের পূর্ণতা ঘটেছে।
পড়ুন : পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্র
সেদিন থেকে ‘সিন্ধুপারে’ কবিতাটিতে যেন রূপকথার রসে জারিত করে জীবনদেবতার আদি অন্তহীন আত্মিক অস্তিত্বকেই মৃত্যুর পরপারের জীবনে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার ছবি আমাদের চেনা রবীন্দ্রজগতের নয়। যেহেতু মৃত্যুর পরপারের নবজীবনের কথা এখানে বলা হয়েছে, তাই সেই জীবনকে বর্তমানের বাস্তব করে আঁকা যেত না। মৃত্যুর পরপারের জীবন আমাদের কাছে রূপকথারই জীবন, পুরাণেও আছে বৈতরণীর ওপারে মৃত্যু তীরের কথা।
কাজেই যেই জীবনের বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কবিকে রূপকথা ও রোমান্সের আয়োজন করতে হয়েছে। কবিতাটির পরিবেশ নির্মাণে, রূপকথার রহস্যময় আবহ তৈরিতে যে বাক্-প্রতিমা ব্যবহৃত হয়েছে তা অতুলনীয়। ভাষায়-ছন্দে-অলংকারে, রোমান্সীয় কবি কল্পনার সঙ্গে তত্ত্বভাবনার আশ্চর্য সমন্বয়ে ‘সিন্ধু পারে’ একটি সার্থক কবিতা হয়ে উঠেছে। “সিন্ধুপারে” নামটিও সেই ব্যঞ্জনাকে গভীরতা দিয়েছে।