পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গা চরিত্র আলোচনা কর

পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গা চরিত্র আলোচনা কর

পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গা চরিত্র :

বিভূতিভূষণ তাঁর পথের পাঁচালীতে প্রকৃতির পটভূমিতে মহাকালের গতিচঞ্চল জীবন রহস্যের সন্ধানে ব্রতী হলেও তাঁর উপন্যাসে অনিবার্যভাবে একটি সমাজ ও পরিবার এসে পড়েছে। এই সমাজও পরিবার নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতি সহ সব মানুষ জনকে নিয়ে। কিন্তু তবুও আমরা জানি পথের পাঁচালী কোন সামাজিক বা পারিবারিক উপন্যাস না, প্রকৃতির আধারে এটি একটি শিশুমনের হয়ে ওঠার বিবর্তনের ইতিহাস বা ধারাবাহিক জীবনপ্রবাহের চিরন্তনতার পরিচিতি। এর মূল লক্ষ‍্য এইটিই। সেই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে একটি পরিবারকে-পরিবারের কিছু চরিত্রকে এনেছেন বিভূতিভূষণ।

প্রকৃতির আওতায় যে শিশুমনের ক্রমবিবর্তন বা বিকাশ রূপায়িত সেই শিশুটি হল অপু। পথের পাঁচালীতে অপু ও প্রকৃতি অভিন্ন। প্রকৃতিকে অপুর বাইরে রেখে কিংবা অপুকে প্রকৃতির বাইরে রেখে তার বিকাশের চিন্তা তাই অচিন্ত্যনীয়। এই সঙ্গে আর একটি চরিত্রকে বাদ দিলে অপুর ‘হয়ে ওঠার’ প্রকৃত স্বরূপটি নেপথ্য থেকে যায়- সম্পূর্ণ অপুর বদলে মেলে অর্ধেক অপু। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েও যাকে নিয়ে অপু একটি পরিপূর্ণ অবয়ব সে চরিত্রটি হোল তার দিদি দুর্গা। যেদিন থেকে ছোট্ট অপু-শক্ত পায়ে মাটিতে দাঁড়াতে শিখেছে সে দিন থেকেই দুর্গা তার হাতে হাত রেখে তাকে প্রকৃতির রহস্য রাজ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছে।

ভূমিষ্ঠ হয়ে অপু তার জননীর পাশাপাশি নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতি আর তার দিদিকে দেখেছে। তাই অপুর জন্ম থেকে দুর্গা তার নিজের মৃত্যু অবধি ছোট্ট ভাইটিকে নিজের কাছ থেকে একদিনের জন্যও দূরে রাখেনি। নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতিতে দুর্গা-অপু একই বৃন্তে দুটি ফুল। যেখানে অপু সেখানে দুর্গা, যেখানে দুর্গা সেখানে অপু। সত্যি বলতে কি এ দুটি চরিত্র একই শিশু চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ। স্বভাবে বা প্রকৃতিতে দুর্গা অপুর মতো নয়। দিদির হাত ধরে অপুর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরায় আছে একটা রোমান্টিক বিস্ময় বোধ এবং মুগ্ধতা কিন্তু দুর্গার মধ্যে তা নেই। সে অনেকটা বাস্তববাদী।

নোনা-আম-মানকচু-নারকেল প্রভৃতি ভোগ্য ফল কিংবা উদ্ভিদ খুঁজে সংগ্রহ করা তার কাছে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর একটা বড়ো উদ্দেশ্য। সে খুঁজে খুঁজে নাটাফলের বীজ সংগ্রহ করে খেলাঘর সাজানোর জন্য। অপু ঠিক এর উল্টো। অপু ধীর-স্থির-শান্ত ও অর্ন্তমুখী। কিন্তু দুর্গার অবস্থান এর বিপরীত কোটিতে। সে চঞ্চল, একগুঁয়ে এবং অবাধ্য ও লোভী। এর সঙ্গে আর একটি বদ রোগও তার চরিত্রে যুক্ত। এই রোগটি তার হাতটান। অন্যের দ্রব্য সে অনায়াসে অপরের চোখেকে ফাঁকি দিয়ে হাতাতে পারে। জঙ্গলে তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি, কেবল কোথায় কি প্রয়োজনীয় জিনিস আছে খুঁজে বার করা। এ সব বিষয়ে অপু, দুর্গার তুলনায় হাঁদা।

যদিও এই দুর্গাই অপুর প্রাকৃতিক বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক। সেই-ই অপুকে প্রথম নিয়ে গিয়েছে জঙ্গলের রাজ্য-প্রকৃতির মাঝখানে। কিন্তু চোর-অবাধ্য-একগুঁয়ে হওয়া সত্ত্বেও দুর্গার মধ্যে ছিল তার ছোট্ট ভাই অপু এবং জন্মদুখিনী পিসির জন্য অফুরন্ত মমতা। সহায়হীনা-অবহেলিতা পিসির মরুজীবনে দুর্গা ছিল মরুদ্যান বিশেষ। তার মাঝেই বল্লালী বালাই ইন্দির ঠাকরুণ তার মৃতা মেয়ের প্রতিরূপ খুঁজে পেয়ে সান্ত্বনা পান-দুঃখ ভোলেন। নিঃসঙ্গ পিসিকে সঙ্গ দিয়ে তার একাকীত্বকে দূর করে সে। পিসি-ভাইঝির পারস্পরিক আন্তরিক টানে অনেকেই দুর্গাকে তাই ইন্দির ঠাকরুণের পূর্বজন্মের মেয়ের ভূমিকায় বসিয়ে দেয়।

দুর্গার বয়স দশ/এগারো। ‘গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মত অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা। হাতে কাঁচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ-মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মত চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর।’ দুর্গার চেহারার বিবরণে অপুর থেকে তেমন কোনো ভয়ঙ্কর তফাৎ না থাকলেও চুলের বর্ণনায় কিছু তফাৎ দেখা যায়। দুর্গার চুল রুক্ষ এবং তেলের অভাবে তা বাতাসে উড়ছে। জানা যায় পথের পাঁচালীর পান্ডুলিপিতে দুর্গার চরিত্র নাকি প্রথমে ছিলো না। বিভূতিভূষণ উস্কো-খুসকো রুক্ষ চুলের দুর্গার বয়সী একটি মেয়েকে দেখে পথের পাঁচালীতে জায়গা দেন। বলা যায় সেই আগন্তুক মেয়েটি দুর্গাতে রূপান্তরিত হয়ে পথের পাঁচালীর সম্পদে পরিণত হয়েছে।

দুর্গা দামাল-চোর তবুও তার মর্ত্যপ্রীতি, জীবনবাসনা ও নরম মন তাকে আমাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ছোট্ট ভাই অপুর কাছে রেললাইনের কথা শুনে তার রেলগাড়ী দেখার সাধ জেগেছিল খুব। এর পর নীরেনের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাকে ঘিরে যে নবজীবনের আকাঙ্খা-সেই আকাঙ্খা রেলগাড়ী দেখার সাধকে যেন আরো তীব্রতর করে দেয়। গোটা পথের পাঁচালীতে সে অপুর মত কল্পনা কিংবা স্বপ্ন কোনোটাই দেখেনি, কেবল একটিবার ছাড়া। সে স্বপ্ন নীরেনকে ঘিরে নবজীবনের স্বপ্ন। কিন্তু দুর্গার সে সাধ-সে স্বপ্ন কোনটাই পূর্ণ হয়নি। চুরির অপরাধে মারের চোটে নাকে-মুখে রক্তের দাগ নিয়েও সে একটি বারের জন্য সোনার সিঁদুর কৌটো আত্মসাতের কথা স্বীকার করেনি। সে বোধহয় নীরেনকে নিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের ভয়ে।

কিন্তু একদিন সব স্বপ্ন ছিড়ে গেল তার। মার খাওয়ার কিছুদিন পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্গা শয্যা নিয়েছিল। এই শয্যাই ছিল তার শেষ শয্যা। তার শেষ শয্যার অন্তিম বাসনা লেখক একটি করুণ আবেদনে শেষ করেছেন। দুর্গা তার ছোট্ট সোনার ভাইটির কাছে শেষ করুণ মিনতি জানিয়ে বলেছে- ‘আমায় একদিন তুই রেলগাড়ী দেখাবি?’ তার রেলগাড়ী দেখা হয়নি। তার এই সামান্য সাধ পূর্ণ হয়নি। অপূর্ণই থেকে গেছে। অন্তিমের অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে দুর্গার এই চলে যাওয়া পাঠককে পীড়িত করেছে-বেদনা বিধুর করেছে। ভালো-মন্দে মেশানো দুর্গাই পাঠকের মনের মণিকোঠায় তার কীর্তি-অকীর্ত্তি ও অকাল মৃত্যুর ভেতর দিয়ে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে- যা পথের পাঁচালীর অন্য কোনো চরিত্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দুর্গা পাঠকের কাছে চিরকালের অবিস্মরণীয় চরিত্র।

আরও পড়ুন :

পথের পাঁচালী উপন্যাসে অপুর চরিত্র

জীববৈচিত্র্য কাকে বলে ? শ্রেণীবিভাগ 

 

Leave a Comment