পথের পাঁচালী উপন্যাসে ইন্দির ঠাকরুণ চরিত্র :
ইন্দির ঠাকরুণ পথের পাঁচালীর ‘বল্লালী বালাই’ অংশের মুখ্য চরিত্র এবং নায়িকা। হরিহর রায়ের দুঃসম্পর্কের দিদি ,আশ্রিতা এবং অবহেলিতা। বল্লালী কৌলীন্য প্রথার শিকার হয়েছেন তিনি। বহু বিবাহের অন্যতমা একজন হওয়ায় স্বামী সঙ্গ কিংবা স্বামীসুখ তাঁর বেশীদিন ঘটেনি। অল্প বয়সেই বৈধব্যকে স্বীকার করতে হয়েছিল। তবে সন্তান সুখ তিনি পেয়েছিলেন। বিশ্বেশ্বরী নামে এক কন্যার জননী ছিলেন তিনি। সেই একমাত্র কন্যার বিবাহও হয়েছিল। কিন্তু জন্ম থেকে দুর্ভাগ্য যার নিত্য সঙ্গী তাঁর সুখটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার একমাত্র কন্যাও একদিন তাঁকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিল। একে তো স্বামীর ঘর কেমন জিনিস তা তিনি দেখেননি তার উপর যে বাপ- ভায়ের আশ্রয়ে ‘দু মুঠা অন্ন পাইয়া আসিতেছিল’ সে বাপ এবং ‘ভাইও অল্প বয়সে মারা গেল।’ একে তো গোড়া থেকেই তাঁর জীবনের ভিত পাকা ছিল না তার উপর অল্প বয়সে ভাই-এর মৃত্যু মাথার উপর ছাউনিটুকু পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে গেল। নিরাশ্রয়-ছিন্নমূল হলেন তিনি। আর তখন থেকেই হরিহরের বাবা রামচাঁদের আশ্রিতা তিনি। একদিন এই আশ্রয়দাতা রামচাঁদও দেহ রাখলেন। তেমন কিছু রেখে না গেলেও মৃত্যুর আগে হরিহরের দায় দিয়েগেলেন এই অভাগী ইন্দির ঠাকরুণকে। ভালোবাসায়-মমতায় সেই হরিহরকে তিনি বড়ো করেছেন।
ইন্দির ঠাকরুণ হরিহরের নিজের কেউ হয় না। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা বড় দূরের। মামার বাড়ীর সম্পর্কে কি রকমের বোন। কিন্তু তা হলে কি হয়। ইন্দির ঠাকরুণ সবই নিজের মতো ভেবে হরিহরকে মানুষ করেছেন- বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন এমন কি হরিহর যখন নব বিবাহিতাকে তার বাপের বাড়ীতে ফেলে আট-দশ বছর দেশ ছাড়া হয়েছিলো তখনও হরিহরের ভদ্রাসনটিকে তার পুনঃ প্রত্যাবর্তনের আশায় অতিকষ্টে ও যত্নে টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এতো করেও, দুর্ভাগ্যের নিত্য সঙ্গিনী ইন্দির ঠাকরুণের কপাল ফেরেনি। ‘হরিহরের বৌ দেখিতে টুকটুকে সুন্দরী হইলে কি হইবে, ভারী ঝগড়াটে, তাহাকে তো চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারেনা।’ প্রায়ই বলে- ‘কোথাকার কে তার ঠিকানা নাই– বসিয়া বসিয়া অন্ন ধ্বংস করিতেছে।’ বস্তুতপক্ষে এইটিই পথের পাঁচালীতে আমাদের দেখা ইন্দির ঠাকরুণের জীবন এবং দিনপঞ্জী।
তাঁর এই দিনপঞ্জীতে সুখের আঁচড়টুকু পর্যন্ত ছিলনা তা একেবারে নয়। দুঃখের -কষ্টের কিংবা লাঞ্ছনার তালিকা দীর্ঘ হলেও এরই মাঝে তাঁর জীবনে মরুদ্যানের মত দেখা দিয়েছিল হরিহর-সর্বজয়ার একমাত্র কন্যা দুর্গা। শত দুঃখেও এই দুর্গাই ছিল তাঁর চরমতম সান্ত্বনা-পরমতম আশ্রয়। বৃদ্ধা পিসির প্রতি তার প্রেম-মমতা এবং ভালোবাসা ইন্দির ঠাকরুণের মৃতা কন্যার অভাব পুরণ করতো। তাঁর বয়স পঁচাত্তর। এই বয়সে এতখানি শরীর হওয়ার কথা নয় কিন্তু অনেক দুঃখে- বেদনায়-অন্নাভাব-অপুষ্টি আর নিত্য বাক্য যন্ত্রণায় শরীর মন দুই-ই তাঁর ভেঙ্গেছে। চোখে ভালো ঠাওর হয়না-মাজা ভেঙ্গে যাওয়ার দরুণ চলতে গেলে শরীর ঈষৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
নিশ্চিন্দিপুরের বুকের ওপর অনেক ওঠা-পড়া, অনেক পরিবর্তন তিনি দেখেছেন। তিনি এ অঞ্চলের অনেক কিছুরই সাক্ষী রয়েছেন। এ গ্রামের তিনিই বল্লালী আইনের, নির্দয় কুলপ্রথা ও বহুবিবাহের যন্ত্রণাভোগিনীদের শেষ প্রতিনিধি। তিনি রায় বংশের তিনপুরুষের ধারাবাহিকতার সাক্ষীও। সারাজীবন রায় বংশের মঙ্গলের জন্যই কষ্ট স্বীকার করেছেন। কেবল হরিহরের প্রতি তাঁর অগাধ স্নেহ, ভালোবাসাই নয়, হরিহরের একমাত্র পুত্র অপুর জম্মগ্ৰহনে সবচাইতে বেশী খুশী ও আনন্দিত হয়েছিল এই বছর পঁচাত্তরের বল্ললী বলাই বৃদ্ধায়।