পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্র

 

থের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্র

সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আজকের এই পরবর্তীতে তোমাদের সাথে শেয়ার করতে চলেছি পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্রটি সম্পর্কে।

পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্র :

উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টিতে বিভূতিভূষণের দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা গঠন পদ্ধতি অনেকের চাইতে একেবারে আলাদা। তাঁর কোনো চরিত্র তেমন কোনো-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা জটিলতার জটিল আবর্তে জরায়নি। মানুষের সাদা মাটা জীবনে গ্লানি ও তুচ্ছতাকে স্বীকার করে নিয়ে তার মধ্যে নিহিত মহিমা ও প্রসন্নতাকে খুঁজে বের করে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছেন। তাই তাঁর কোনো চরিত্রই উগ্র ঝাঁঝালো ‘বাদে’ আক্রান্ত নয়। নারী চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর গঠন ভাবনার আলাদা একটা চেহারার খোঁজ মেলে। তিনি শরৎচন্দ্রের মতো রহস্যময়ী প্রেমিকা নারীর কিংবা সামগ্রিকভাবে নারীর বিচিত্ররূপকে আবিষ্কারের নেশায় ফেরেননি। আবার অন্যদিকে নারীীকে কেবলমাত্র আদর্শবাদী পূজনীয়ারূপে ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। দোষে-গুণে জড়ানো আমাদের বাংলা নারীর যে চিরন্তন বাস্তব রূপ সেই রূপকেই তিনি প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।

ষড় রিপুর সব কিছু জয় করতে পারলে যে নারীকে আমরা সর্বজয়া নামে চিহ্নিত করতে পারি পথের পাঁচালীর সর্বজয়া ঠিক ততোখানি নয়। নামে সর্বজয়া হলেও ততোখানি অবিশ্বাস্য আদর্শে তাঁকে বিভূতিভূষণ গড়তে পারেনি। পথের পাঁচালীর সর্বজয়া-দোষে গুণে বাস্তব সর্বজয়া। একসময় কথাপ্রসঙ্গে এই সর্বজয়া চরিত্রে বিভূতিভূষণ তাঁর মায়ের একটা ধাঁচের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন এই চরিত্রটাই নাকি ঐজন্যেই খানিকটা বাস্তব ঘেঁষা। বিভূতিভূষণের মায়ের ধাঁচ থাকা-না থাকার বিতর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা কথা অবশ্যই জোর দিয়ে বলা যায় পথের পাঁচালী উপন্যাসে সর্বজয়া চরিত্রের বাস্তবতা সন্দেহের বাইরে।

সর্বজয়া হরিহর রায়ের স্ত্রী এবং দুর্গা-অপুর স্নেহশীলা মা। হরিহরের অভাবের সংসারে সে প্রায় নিঃসঙ্গ লড়াই চালিয়ে যায় দারিদ্রকে সামাল দিয়ে দুটি ছোট্ট-ছোট্ট সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য। ঘর বেঁধেও-ঘরণী এনেও তার স্বামী সংসার সম্পর্কে স্বভাব উদাসীন। বিয়ের পরে নববিবাহিতা বধূতে পরিণত হওয়ার সময় থেকেই সে বুঝে নিয়েছে স্বামীর ঘর-উদাসীন যাযাবরী মনকে। তাই সে একাই দুহাতে-ডাইনে বাঁয়ে একাধারে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছে।

সর্বজয়ার চরিত্র প্রকৃত ভালো মেয়ে বা নির্ভেজাল মহীয়সী মহিলার নয় সে অনেক দোযে দোষী। তার চরিত্রে অনেকগুলি দোষ আছে। সে অপত্য স্নেহে অন্ধ, তাই দুর্গার না বলে অন্যের গাছের নারকেল কুড়িয়ে এনে লুকিয়ে ফেলার ভেতর দিয়ে সে প্রশ্রয় দিয়ে বসে চৌর্য বৃত্তিকে। পঁচাত্তর বছরের জরাগ্রস্ত ননদকে সে অকারণে অবহেলা করে, তার সঙ্গে অকারণে কলহ করে এবং গৃহ থেকে বিতাড়িত করে। গ্রাম্য মেয়ে সে, শিক্ষা-দীক্ষার লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে। এরই সঙ্গে সে ছিল ভয়ঙ্কর স্বার্থপর এবং সংকীর্ণচিত্ত। তার এইসব অপগুণগুলি ছিল তার চরিত্রের অন্ধকারের দিক। কিন্তু এরই মাঝে সর্বজয়ার চরিত্র কোথাও কোথাও আলোয় উদ্ভাসিত।

দুঃখে-কষ্টে দিন চললেও অভাব-অনটনকে মেনে নিয়েছে সে অন্তর থেকে। এ নিয়ে তার কোথাও বা কারো কাছে কোনো অভিযোগ নেই-কাঁদুনি নেই, বরঞ্চ সন্তানদের মুখ চেয়ে হাসিমুখে সে দুঃখকে বরণ করে নিয়েছে। নিত্য অভাব ও অভাবজনিত কষ্টের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে কখনও কখনও সে ধৈর্য হারিয়ে হয়তো নিজের সন্তানদের উপর রুষ্ট হয়েছে বা রূঢ় ব্যবহার করেছে, কিন্তু পরক্ষণেই মমতা-মেদুর স্নেহ-সোহাগে তাদের জড়িয়ে ধরেছে। এ সবের ভেতর দিয়ে তার মধ্যে ধরা পড়ে বাঙ্গালী মাতৃভাবনার সার্থক প্রকাশ।

সর্বজয়া চরিত্রের মধ্যে আছে একটা স্ববিরোধী ভাব। অশিক্ষিতা হলেও এবং শত অভাব সত্ত্বেও তার প্রখর মর্যাদাবোধ আমাদের বিস্মিত করে। দাসী ঠাকরুণের কাছে পয়সা না দিয়ে ইন্দির ঠাকরুণের আগাম একটা নোনা চেয়ে খাওয়ার সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় তার এই মর্যাদা- বোধের চিত্রটি স্পষ্ট হয়। অথচ আশ্চর্য সর্বজয়ার এই মর্যাদাবোধে সামান্যতম টোল পড়ে না যখন তারই আত্মজা অপরের গাছের নারকেল কিংবা পুঁথির মালা না বলে ঘরে আনে। তবুও চরিত্রের এই দোষ-ত্রুটি নিয়েই সর্বজয়া আমাদের মন কাড়ে-আমাদের সহানুভূতি আদায় করে নেয়। সে কেবল তার মাতৃত্বের অপরূপ মহিমায়।

সর্বজয়ার লোভ-কলহপ্রবণতা কিংবা ননদের প্রতি অমানবিক ব্যবহারের সঙ্গে অপার-অগাধ সন্তান স্নেহ মিশিয়ে এক অপরূপ মাতৃ-মহিমা- মণ্ডিত বাস্তব চরিত্র এঁকেছেন বিভূতিভূষণ। স্নেহের আত্যন্তিকতায় কখনো সে সন্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে তুমুল কলহ করেছে কখনো বা সন্তানকেই প্রহার করেছে ভীষণ ভাবে। এই দ্বৈতরূপে সর্বজয়া পাঠকের মন জয় করেছে।

আরও পড়ুন :

পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গার চরিত্র

পথের পাঁচালী উপন্যাসে অপুর চরিত্র

পথের পাঁচালী উপন্যাসে হরিহর চরিত্র

পথের পাঁচালী উপরা সে ইন্দির ঠাকুরুণের চরিত্র

বুদ্ধি কাকে বলে, বুদ্ধির বৈশিষ্ট্য কাজ ও শ্রেণীবিভাগ ?

রাশিবিজ্ঞান কাকে বলে এর কাজ কারণ উপযোগিতা ?

Leave a Comment