সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, এই পর্বটিতে প্রবাল প্রাচীর কাকে বলে এবং প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার কারণ ও প্রবাল প্রাচীরের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রবাল প্রাচীর কাকে বলে :
মৃত প্রবালের চুনগঠিত কঠিন খোলক বা আবরণগুলি অগভীর সমুদ্র তলদেশে জমা হতে হতে যখন দীর্ঘ অপ্রশস্থ ভূভাগ তৈরি হয়, তখন তাকে বলে প্রবাল প্রাচীর। প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার অনুকূল অবস্থা প্রবাল কীটগুলি অনুকূল পরিবেশে একবার যেখানে জন্মাতে শুরু করে সেখানেই তারা উপনিবেশ গঠনের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। উম্ন মণ্ডলের সমুদ্রে এদের সমাবেশ বেশি করে লক্ষ করা যায়। প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার শর্তগুলি হল-
প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার কারণ :
1. সমুদ্রজলের উষ্ণতা ও গভীরতা : প্রবাল কীটের বংশ বিস্তারের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা অবশ্যই 20°-21° C হওয়া দরকার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 60-75 মিটার গভীরতায় প্রবালকীটের বৃদ্ধির সহায়ক, কারণ এই গভীরতা পর্যন্ত অংশে সূর্যালোক পৌঁছায়।
2. জলের আলোড়ন ও সমুদ্র স্রোত : জলের আলোড়ন ও সমুদ্রস্রোত প্রবাল কীটের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেনের জোগান অব্যাহত রাখে। এজন্য জীবন্ত প্রবাল কীট উপহ্রদের পরিবর্তে উন্মুক্ত সমুদ্রে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
3. পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল : প্রবাল কীটের মুখে পলিকণা জমতে থাকলে তারা অক্সিজেন নিতে পারে না। ফলে এরা পরিপাক করতে পারে না ও মারা যায়। সেই জন্য পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল দরকার।
4. মিষ্টি জলের প্রভাব মুক্ততা : পরিষ্কার মিষ্টি জল প্রবাল কীটের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মোহানা থেকে দূরে এরা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
5. লবণতার পরিমাণ : প্রচুর পরিমাণে চুনের কার্বোনেট প্রবাল কীটের প্রধান খাদ্য। জলের গড় লবণতা 27% থেকে 40%-এর বেশি হয়ে গেলে ওই কার্বোনেটের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রবালকীট বংশবিস্তার করতে ব্যহত হয়।
6. অন্তঃসাগরীর মঞ্চের অবস্থান : তটভূমি বরাবর 50 ফ্যাদম বা 100 মিটার গভীরতায় মহাদেশীয় শক্ত শিলার উপস্থিতি প্রবাল কীটের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের সহায়ক।
প্রবাল প্রাচীর এর শ্রেণীবিভাগ :
প্রবাল প্রাচীর কে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয় যথা-
1. প্রান্তদেশীয় প্রবাল প্রাচীর : অনুকূল পরিবেশে মহীসোপানের ঢালু অংশ বরাবর সংকীর্ণ বলায়াকারে এবং দ্বীপসমূহের চারপাশে যে প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠে, তাকে প্রান্তদেশীয় প্রবাল প্রাচীর বলে। এই প্রবাল প্রাচীরের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
i. এধরনের প্রাচীর তুলনামূলক সংকীর্ণ হয় ও এর বিস্তৃতি অপেক্ষাকৃত কম।
ii. কখনো কখনো প্রান্তদেশীয় প্রবাল প্রাচীর তটভূমি থেকে সংকীর্ণ অগভীর উপহ্রদ দ্বারা বিছিন্ন থাকে। দক্ষিণ ফ্লোরিডা প্রাচীর প্রান্তদেশীয় প্রাচীর-এর উদাহরণ।
iii. স্থলভাগের দিকের অংশের চেয়ে সমুদ্রের দিকের প্রান্তভাগ কিছুটা উঁচু হয়।
iv. প্রবালের পাতলা স্তর দিয়ে এই প্রাচীর গঠিত হয়।
2. প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর : স্থলভাগ থেকে প্রশস্ত অগভীর উপহ্রদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন অনুদৈর্ঘ্য অথবা বৃত্তাকার প্রবাল প্রাচীরকে প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর বলে। প্রান্তদেশীয় প্রাচীর বিবর্তিত হয়ে পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিবন্ধক প্রাচীরে পরিণত হয়। এই প্রবাল প্রাচীরের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
i. সমুদ্রের অনেক গভীর (60 মি. বা 30 ফ্যাদমের অধিক) অংশ থেকে এই প্রাচীরের বৃদ্ধি ঘটে।
ii. প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর বেশ চওড়া হয় এবং এদের আকৃতি সাধারণত অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে থাকে। এর শিং বা প্রান্তদুটি স্থলভাগের অভিমুখে থাকে।
iii. এই প্রবাল সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপরে উন্মুক্ত অংশ থেকে কয়েক কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
iv. এই প্রবাল প্রাচীর স্থানে স্থানে অনেক পরিখা দ্বারা প্রাচীরটি বিচ্ছিন্ন থাকে, যার মধ্য দিয়ে উপহ্রদ ও সমুদ্রের মধ্যে সংযোগ গড়ে ওঠে।
পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীরটি হল অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট বেরিয়ার রিফ। এটি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব দিকে বিস্তৃত।
3. অ্যাটল : প্রতিবন্ধক প্রাচীর গঠনের পর একদম শেষ পর্যায়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বৃত্তাকার বা প্রায় বৃত্তাকার উপহ্রদ পরিবেষ্টনকারী যে প্রবাল প্রাচীর গঠিত হয়, তাকে বলা হয় অ্যাটল। অ্যাটলের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ-
i. অ্যাটলগুলির মাঝে অগভীর উপহ্রদ থাকে যার সর্বাধিক গভীরতা 30 থেকে 50 মিটার হয়।
ii. নিমজ্জমান সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরি বা সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উত্থান ও পতনের সঙ্গে এদের উৎপত্তি বিশেষভাবে যুক্ত।
iii. অ্যাটলে অনেক সংযোগকারী পরিখা থাকে। ওইসব পরিখা দিয়ে উন্মুক্ত সমুদ্রের জল উপহ্রদে প্রবেশ করে।
iv. এদের আকৃতি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার হয়।
v. উপহ্রদের মধ্যে প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ জমে জমে সরু ফালির আকারে বৃত্তচাপের মত দ্বীপ গড়ে ওঠে, যা মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হয়।
vi. কোনো কোনো অ্যাটল মহাদেশীয় ভূখণ্ড থেকে কয়েকশত কিমি দূরে সমুদ্রে অবস্থান করে।