আমাদের এই পর্বটিতে জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির কারণ গুলি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো।
জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির কারণসমূহ :
সমগ্র বিশ্বেই জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে চলেছে। United Nations Environment Programme-এর হিসেব অনুযায়ী এই বিশ্বে প্রায় 2.2 কোটি জীব প্রজাতি রয়েছে। আগামী 30 বছরের মধ্যে 70 লক্ষ জীবপ্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। পাখি ও সরীসৃপ নানা প্রজাতির মধ্যে যথাক্রমে তিন-চতুর্থাংশ ও এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্তির পথে। নির্বিচার অরণ্য ধ্বংসের ফলে মোট সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রায় 10 শতাংশ আজ বিলুপ্তপ্রায়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই বিলুপ্তির একাধিক প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন-
1. প্রাকৃতিক কারণসমূহ :
জলবায়ুর পরিবর্তন : বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে একাধিকবার জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এর পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন প্রজাতি আভিযোজন না ঘটার জন্য তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে। কার্বনিফেরাস ও প্লিস্টোসিন যুগে সমগ্র পৃথিবী বরফাবৃত থাকায় অসংখ্য প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। @ অগ্ন্যুৎপাত: অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে সৃষ্ট লাভা প্রবাহে বহু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
ধূমকেতুর পতন : মহাকাশ থেকে আগত ধূমকেতু পৃথিবীপৃষ্ঠে আছড়ে পড়লে সেখানকার জীবের মৃত্যু ঘটে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় : বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ও সুনামি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বহু প্রজাতির জীবের বিনাশ ঘটে ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
2. মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহ :
আবাসস্থলের সংকোচন : পৃথিবীতে জনসংখ্যার অত্যধিক চাহিদা পূরণ করার জন্য নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করে যাচ্ছে। এর ফলে উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ও তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থলগুলিও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক প্রাণীর বিচরণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দরকার। আবাসস্থলের সংকোচন হলে তারা ঠিকমতো প্রজনন করতে পারে না। মানুষের তথাকথিত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ, যেমন বনাঞ্চল কেটে কৃষিজমির সম্প্রসারণ, আবাসন প্রকল্প তৈরি, কলকারখানা স্থাপন প্রভৃতির জন্য অরণ্যাঞ্চল ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ও জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে।
বন্যপ্রাণীর সংহার : বিভিন্ন বন্যজীবকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে সেই প্রজাতিগুলি ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, গন্ডারের খড়গ প্রভৃতির জন্য সেই জীবদের এমন হারে হত্যা করা হয়েছে যে বর্তমানে তারা বিলুপ্তপ্রায় বলে গণ্য হচ্ছে।
ভিন্নদেশ থেকে আগত প্রজাতি : যে-কোনো বাস্তুতন্ত্রের নিজস্ব গঠনবৈচিত্র্য থাকে। বাইরে থেকে হঠাৎ কোনো প্রজাতি এলে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের গঠন বিনষ্ট হয়। এতে স্থানীয় প্রজাতির বৈচিত্র্য ভীষণভাবে হ্রাস পায়। যেমন-পার্থেনিয়াম নামক গুল্ম ও কচুরিপানা বিদেশ থেকে এনে এদেশে স্থাপন করায় আমাদের বাস্তুতন্ত্র ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশ আমদানি হওয়ার পর থেকে সেখানকার অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ বিনষ্ট হয়ে গেছে।
অত্যধিক হারে উদ্ভিদ প্রজাতির আহরণ : বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে বিভিন্ন বৃক্ষলতা ও গুল্ম আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চল থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্মগুলি সংখ্যায় অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
পরিকল্পনাবিহীন উন্নয়ন : যে-কোনো উন্নয়নমূলক কাজে হাত দেওয়ার আগে পরিবেশের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। ভারতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বাঁধ, জলাধার, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলির পরিবেশগত ঝুঁকি আগে থেকে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর ফলে এইসব পরিকল্পনা রূপায়ণে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্র প্লাবিত হয়েছে, আদিবাসীরা বাস্তুভিটে হারিয়েছে এবং অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বিভিন্ন প্রকারের দূষণ : সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে জলদূষণ, বায়ুদূষণ ও মৃত্তিকাদূষণের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বাড়ছে। এই দূষণের ফলে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। প্রকৃতিতে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশককেই দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অধীক বায়ুদূষণের ফলে পোল্যান্ডের একটি জাতীয় উদ্যানে একবার ৪৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে চিলজাতীয় পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণও হল প্রকৃতির দূষণ।
অপর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা : জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত সঠিক ও পর্যাপ্তভাবে আইন প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রচলিত আইনগুলিও সঠিক পরিচালন ব্যবস্থার অভাবে তা প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। যতদিন না উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হবে ও কঠোরভাবে তা বলবৎ করা হবে ততদিন জীববৈচিত্র্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না।