ওয়ারেন হেস্টিংস প্রবর্তিত পাঁচসালা এবং একসালা বন্দোবস্তের ত্রুটিগুলি দূর করার জন্য ১৭৮৪ সালে পিটের ভারত শাসন আইনে জমিদার সহিত স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ করা হয়। ইংল্যান্ডের পরিচালক সভাও বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের আদেশ দিয়ে কর্নওয়ালিশকে ১৭৮৬ সালে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে পাঠান। কর্নওয়ালিশ ১৭৮৬ সালে বড়োলাট হয়ে ভারতবর্ষে এসে এদেশের ভূমিব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তৃত কার্যকলাপ চালান। ১৭৯৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। তাঁর শাসনকার্যে এই ব্যবস্থা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ :
লর্ড কর্নওয়ালিশ দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পেছনে বেশ কতগুলি উদ্দেশ্য বা কারণ ছিল যেগুলি হল-
১. অভিজাত গোষ্ঠীর উদয় : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশদেরঅনুগামী একটি নতুন অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটবে। তারা ইংরেজদের মূল সমর্থক হয়ে কাজকর্ম করবে।
২. বাজেট তৈরির সুবিধা : রাজস্ব থেকে প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় হলে সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ আরও সহজ হবে।
৩. নির্দিষ্ট রাজস্ব আয় : কোম্পানির আশাবাদী ছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে তারা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে যার ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা লুপ্ত হবে।
৪. রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি : জমিতে স্থায়ী অধিকার পেয়ে সকল জমিদাররা কৃষি এবং কৃষকের উন্নতির জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নেবেন। এতে দেশের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে এবং পরোক্ষে কোম্পানিরই মুনাফা অর্জন হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্ত :
কর্নওয়ালিশ বিলাতের পরিচালক সভার অনুমোদন ভার পেয়ে ১৭৯৩ সালে দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাম দেন। প্রথমদিকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যায় এবং পরে বারাণসী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কিছু কিছু স্থানে এই ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। চিরস্থায়ী ব্যবস্থার শর্ত গুলি ছিল-
১) জমির প্রাপক জমিদার এবং তালুকদাররা বংশানুক্রমিকভাবে জমির উপর অধিকার পারবেন।
২) নির্ধারিত ভূমি-রাজস্বের শতকরা হিসেবে ৮৯ ভাগ সরকার এবং ১১ ভাগ পাবেন জমিদার।
৩) ইচ্ছানুযায়ী জমিদার জমি দান-বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবেন।
৪) নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে রাজস্ব শোধ করতে না পারলে তাকে সমস্ত জমিদারি বা তার অংশ বিক্রয় করে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব শোধ করতে হবে। তা না হলে তার জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।
৫) ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ১৭৯৩ সালের হার অনুযায়ী বহাল থাকবে।
৬) সূর্যাস্ত আইনে জমিদাররা সরকারের পর্যপ্ত রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে পরিশোধ করা আবশ্যক।
৭) ভবিষ্যতে খরা, মহামারি, বন্যা বা অন্য যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও রাজস্বের কোনো ছাড় হবে না।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল :
কর্নওয়ালিশ ভারতে প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থা বিষয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষার পর শেষে ১৭৯৩ সালে ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। এই বন্দোবস্তের প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক ও বিভূ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নানা বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলের প্রতি বেশি আলোকপাত করেন। অপরদিকে কেউ কেউ এই বন্দোবস্তের কুফল গুলির উপর বেশি গুরুত্ব আলোকপাত করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল গুলি নীচে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল-
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল :
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, “১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ জাতির গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ ও সফল পদক্ষেপ।” স্মিথ মনে করেন যে, “লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে এক বিপ্লব ঘটান।” মার্শম্যানের মতে, “এটি (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) ছিল একটি দৃঢ়, সাহসিকতাপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ।” এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন সুফলগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল
১. বাজেট তৈরিতে সুযোগ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব অর্জন সুনিশ্চিত হয়। যার ফলস্বরূপ সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরিতে সুবিধা হয়।
২. কৃষির উন্নতি সাধন : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির ওপর জমিদারের স্বত্ব ও অধিকার সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা নিজ এলাকার জমি ও কৃষির প্রতি যত্নবান হন।
৩. উৎখাতের আশঙ্কা মুক্তি : কৃষকদের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদেরও সুবিধা হয়। তারা ইজারাদারদের শোষণ ও জমি থেকে ঘন ঘন উৎখাতের আশঙ্কা থেকে পরিত্রাণ পায়।
৪. ব্রিটিশদের শাসনের ভিত্তি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকারের অস্তিত্বের ওপর জমিদারদের অস্তিত্ব নির্ভর ছিল। তাই জমিদাররা সরকারের উদ্দেশে আনুগত্য জানিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষায় উদ্যোগী হয়। তাদের সমর্থনের বলে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল :
নানান ঐতিহাসিকগন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর বিভিন্ন সুফল উল্লেখ করলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে এই বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফলই অধিক ছিল। ঐতিহাসিক হোমস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে “একটি-দুঃখজনক-ভুল” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এডওয়ার্ড থর্নটনের মতে, চরম অজ্ঞতার মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর উদ্ভব হয়। এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন কুফলগুলি নিম্নে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হল-
১. জমির উন্নতি ব্যাহত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় চাষিরা জমির উন্নতির জন্য তেমন চেষ্টা করত না। জমিদাররাও জমির উন্নতি, সেচের বৃদ্ধি, কৃষির উন্নয়ন পতিত জমি উদ্ধার ইত্যাদির জন্য অর্থ খরচ না করে জমির আয় তারা নিজেদের বিলাসিতায় খরচ করত। ফলে জমি ও কৃষির উন্নতি ব্যপকভাবে বিঘ্নিত হয়।
২. জমিদারির অবসান : ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারের কাছে রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে বহু পুরোনো জমিদার তাদের জমিদারি থেকে বঞ্চিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার প্রথম কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক পুরাতন জমিদার তাদের জমিদারি হারান।
৩. কৃষকদের উৎখাত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এর দ্বারা কৃষকরা তাদের জমি থেকে ঘন ঘন উৎখাতের আশঙ্কা থেকে ভয় মুক্ত হওয়ার ফলে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করলেও অনেকেই মনে করেন যে এই ব্যবস্থায় জমিদার অধিক রাজস্ব পাওয়ার তাগিদে চাষিকে জমি থেকে প্রতিনিয়ত উৎখাত করত। কারণ এই বন্দোবস্তে জমিতে কৃষকের নামমাত্র অধিকার ছিল না। কোনো চাষির রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষির জিনিসপত্র নিলামে দিত। এজন্য পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মন্তব্য করেছেন, চিরস্থায়ী-বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে-মজুরে পরিণত হয়।
৪. সরকারের ক্ষতি : জমিদাররা চাষিদের থেকে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অধিক পরিমাণে রাজস্ব আদায় করলেও এই বাড়তি রাজস্বের অংশ সরকারের কাছে যেত না। সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় বাড়ার সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া জনসংখ্যাবৃদ্ধি, মূল্যবৃদ্ধি , পতিত জমি উদ্ধার ইত্যাদি থেকে জমিদারের আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও এই বাড়তি আয়ের কোনো অংশ সরকারের কাছে যেত না।
৫. নতুন জমিদারদের উত্থান: পুরোনো বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারালে শহুরে ধনী বণিকরা এই জমিদারিগুলি কিনে নেন। এসব ভুঁইফোঁড় নতুন জমিদারদের গ্রামের কৃষক ও জমির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বা প্রজাকল্যাণের কোনো ইচ্ছা ছিল না। তারা শহরে বসে নায়েব-গোমস্তাদের দিয়ে জমিদারি চালাতেন। প্রজাদের শোষণ করে বেশি অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
৬. কৃষকের শোচনীয় অবস্থা : কৃষকের ওপর প্রচুর পরিমাণ রাজস্বের বোঝা দিয়ে তা আদায় করতে গিয়ে কৃষকের ওপর তীব্র শোষণ ও অত্যাচার চালানো হয়। একটি পরিসংখ্যান থেকে সন্ধান পাওয়া যায় যে, ১৭৯৩ সালে জমিদাররা সরকারকে 35 লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ওই বছর জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ জোর করে 1 কোটি 35 লক্ষ পাউন্ড আদায় করেন।
৭. মধ্যস্বত্বভোগীর উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার এবং জমিদারের মাঝখানে পত্তনিদার, দরদর- পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, ইত্যাদি নানা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়। এসব মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিক পরিমাণে আর্থিক শোষণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কৃষকের চূড়ান্ত ক্ষতির জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিকল্প কোনো ভালো ব্যবস্থা ছিল না। ব্যাডেন পাওয়েল বলেন, কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী-বন্দোবস্ত অনেক প্রত্যাশাকে ধ্বংস করে এমন কিছু প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয় যা চিন্তার বাইরে ছিল।
৮. শিল্প ও বাণিজ্যের লোকসান : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে দ্রুত অধিক পরিমাণে অর্থ উপার্জনের আশায় অনেক মানুষ ব্যাবসাবাণিজ্য ছেড়ে জমিদারির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কুটিরশিল্পের কাজেও লোকের আগ্রহ কমতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য ব্যপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। বাংলার কৃষকদের দুরবস্থার জন্য রমেশচন্দ্র তাঁর “বাংলার-কৃষক” গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই দায়বদ্ধ করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, Dr. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতানুসারে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের খালি চেকে স্বাক্ষর করে দেওয়া হয়। জমিদাররা তাদের মনমতো তাতে টাকার অঙ্ক বসাতে পারেন। Dr. তারা চাঁদ মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতের সামাজিক সংগঠন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। কিন্তু Dr. রত্নলেখা রায় মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা বাংলার গ্রাম সমাজে নতুন কোনো পরিবর্তন আমেনি। শুধু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার গোলোযোগ গুলি উধাহ হয়েছিল মাত্র।
আরও পড়তে নজর রাখুন : |