প্রিয় পাঠক বন্ধুরা এই পর্ব, বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান ও সীমাবদ্ধতা গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ভূমিকা : ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির পশ্চাদগামীতা দূর করার জন্যে যারা অসামান্য অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাজা রামমোহন রায়। ভারতীয় সমাজের মধ্যযুগীয় অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে তিনি বহুমুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এইসব সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান।
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা :
বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে লক্ষ্যে রামমোহন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যাথা-
১. অন্যান্য গ্রন্থ : শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা বাংলা গদ্য রচনার যে পরিকাঠামো গড়ে তোলেন তাতে প্রাণ দেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহনই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম কমা-সেমিকোলন প্রভৃতি যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন। তিনি অলংকারবহুল সংস্কৃত রীতির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল শব্দ ব্যবহারের রীতি চালু করেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তাঁকে “বাংলা গদ্যসাহিত্যের-জনক” বলা হয়।
২. বিভিন্ন রচনা সমূহ : হিন্দুধর্মের সংস্কার এবং একেশ্বরবাদের প্রচারের লক্ষ্যে তিনি বেশ কতগুলি বাংলা পুস্তিকা এবং বিভিন্ন উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি ১৮১৫-১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৩টি গ্রন্থের রচনা করেন। বেদান্ত গ্রন্থ ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
রামমোহনের লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহ ছিল ১৮১৪ সালে বেদান্ত সার, ১৮১৭ সালে ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার, মাণ্ডুক্যোপনিষৎ, ১৮১৯ সালে মুণ্ডকোপনিষৎ সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ ১৮১৯ সালে, ১৮২০ সালে সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার, ১৮২১ সালছ ব্রাহ্মণ সেবধিঃ, ১৮২৭ সালে বজ্রসূচি।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রামমোহন রায়ের ভূমিকা :
রাজা রামমোহন রায় সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেন। ড. বিপান চন্দ্রের মতানুসারে, “রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার-অগ্রদূত।”
১. সংবাদপত্র প্রকাশ : রামমোহন বাংলা, হিন্দি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। জনগণের মধ্যে সাহিত্য-বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ক জ্ঞানের প্রচার এবং সরকারকে জনগণের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথা জানানোর জন্য তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তাঁর প্রকাশিত সংবাদপত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলায় প্রকাশিত “সম্বাদ কৌমুদী” ফারসিতে প্রকাশিত “মিরাৎ-উল-আখবর”।
২. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সরকার ‘প্রেস অর্ডিনান্স’ জারি করলে রামমোহন ১৮২৩ সালে সুপ্রিমকোর্ট ও ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার কাছে প্রতিবাদী চিঠি দেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনে সালিম হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে তাঁর আন্দোলনকে অনেকে ভারতের প্রথম নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মন্তব্য করেন।
রামমোহন রায়ের সীমাবদ্ধতা :
রামমোহন রায়ের চরিত্রে নানান প্রগতিশীল ভাবাদর্শের উপস্থিতি দেখা গেলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাঁর কিছু সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল-
১. জাতিভেদ প্রথায় দুর্বলতা : রামমোহন রায় হিন্দুজাতির ধর্মীয় কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে সামিল হলেও জাতিভেদ প্রথা বা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি যে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেন এর প্রমাণ মেলে তাঁর উপবীত গ্রহণ, বিলেত যাত্রার সময় সাথে ব্রাহ্মণ পাচক নেওয়া, ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এ আচার্যের পদটি ব্রাহ্মণদের জন্য নির্ধারিত করা প্রভৃতি ঘটনা থেকে। মৃত্যুর পর তাঁকে যেন খ্রিস্টান নিয়মানুযায়ী সমাহিত না করা হয় সেবিষয়ে তিনি বারবার সতর্ক করেন।
২. দেশীয় শিক্ষার প্রতি অশ্রদ্ধা : রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি বেশি অনুরাগ দেখাতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষা, দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষা প্রসারের প্রতি অনেকটা অবহেলা দেখিয়েছেন। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি তিনি দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষার প্রসারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।
৩. স্ববিরোধিতা : রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে গিয়ে যুক্তির অপেক্ষা হিন্দু শাস্ত্রগুলির ওপরই নির্ভর করেছেন। বেদান্তের ওপর নির্ভর করে ধর্মীয় সংস্কার করলেও বেদান্তের ত্যাগ বাদের পথে যাননি। এক্ষেত্রে তাঁর চরিত্রে স্ববিরোধিতা ফুঁটে ওঠে।
৪. দরিদ্রদের শোষণে উদাসীনতা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকদের প্রতি রামমোহন সহানুভূতি দেখালেও তাদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি কখনো সরব হননি। কৃষকদের উপর নীলকরদের অত্যাচার বিষয়েও তিনি ছিলেন নীরব।
৫. অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক : রাজা রামমোহন রায় অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু এর করণে দেশের কুটিরশিল্প ধ্বংস হচ্ছে তার প্রতিকারের কোনো উপায় তিনি খুঁজে বার করতে পারেননি।
৬. ব্রিটিশ-সংস্কৃতিপ্রীতি : ইংরেজি ভাষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি রামমোহন রায়ে অত্যধিক অনুরাগের জন্য অনেকে তাঁকে জাতীয়তা বিরোধী বলে চিহ্নিত করেছেন।
মূল্যায়ন : পরিশেষে বলা যায় যে, রামমোহন রায়ের চরিত্রে প্রগতিশীলতা ও কিছু সীমাবদ্ধতার সহাবস্থান দেখা যায়। একদিকে যেমন কোনো কোনো ঐতিহাসিক রামমোহনের সমালোচনা করেছেন তেমনি অপরদিকে অনেকেই তাঁর গুনগান করেছেন। ড.রমেশচন্দ্র মজুমদার ধর্ম-সমাজ-শিক্ষা ও আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে তাঁর সকল অবদানকে অস্বীকার করেছেন।
ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাঁকে “আধুনিক-ভারতের জনক” বলতে রাজি নন। তাঁর মতানুসারে উনিশ শতকের নবজাগরণ কোনো ব্যক্তিবিশেষের অবদান নয়। অন্যদিকে কিশোরীচাঁদ মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাঁকে ‘আধুনিক ভারতের- স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। ড. বিপান চন্দ্র মন্তব্য করেন, “উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারত গগনে রামমোহন-রায় উজ্জ্বলতম নক্ষত্ররূপে-ভাস্বর ছিলেন।”