আজকের পাঠে ভারতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ভারতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা :
ভূমিকা : আধুনিক ভারতে যেসকল সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে হুগলি জেলার অন্তরগত রাধানগর গ্রামে এক রক্ষণশীল ও ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন ভারতবাসীরা কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকারে ডুবেছিল। রামমোহন রায় ভারতীয় সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে জাতিকে এক নতুন আলোর পথ দেখান। তাঁকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ, “আধুনিক-ভারতের জনক”, “আধুনিক-ভারতের-ইরাসমাস” প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করা হয়।
প্রাচ্যের শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ও যুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি এক নবীন ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। তিনি ছিলেন “ভারতীয় নবজাগরণের.অগ্রদূত”। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে দিয়েছিলেন ‘রাজা’ উপাধি। অধ্যাপক রাখালচন্দ্র নাথের মত অনুযায়ী, ‘ইন্ডিয়ান রিফরমেশনে তাঁর কীর্তি অবিনশ্বর’।
রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষা সংস্কার :
১. শিক্ষাচিন্তা : ভারতের অতীত ঐতিহ্য এবং গৌরবের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাবধারার সমন্বয় ঘটানোই রামমোহন রায়ের শিক্ষাচিন্তার প্রধান বিষয় ছিল। সমাজ থেকে কুসংস্কার মুক্ত করে সমাজের কল্যাণ ঘটানো এবং দেশ ও জাতিকে প্রগতির পথে অগ্রসর করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
২. পাশ্চাত্য শিক্ষায় অবদান : রামমোহন রায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের এক উগ্র সমর্থক ছিলেন। তিনি ভারতীয়দের ইংরেজি,পদার্থবিদ্যা, পাশ্চাত্যের গণিত,রাসায়ন, প্রকৃতিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষাগ্রহণের উপদেশ দেন। তিনি তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড-আমহার্স্টকে এক চিঠির মাধ্যমে ১৮২৩ সালে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সরকারি অর্থব্যয়ের অনুরোধ জানান।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : রামমোহন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগ নেন। তিনি স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফকে ১৮৩০ সালে “জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন” প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। রামমোহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় “অ্যাংলো হিন্দু স্কুল” স্থাপন করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি ব্যপক সহায়তা করেন বলে অনেকের ধারণা।
তিনি ডেভিড হেয়ারের শিক্ষাবিস্তারের কার্যে অন্যতম সহায়ক ছিলেন। বেদান্ত শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি ১৮২৬ সালে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজে এবং হেয়ার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত।
৪. বাংলা গদ্যে সাহিত্যের জনক : শ্রীরামপুরের মিশনারিরা বাংলা গদ্যের যে কাঠামো গঠন করেছিলেন তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন রায়। এজন্য তাঁকে “বাংলা গদ্য-সাহিত্যের” জনক বলা হয়। তিনি ১৮১৫-১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৩টি গ্রন্থ রচিত করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার, সহমরণ বিষয়ক প্রবর্ত্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ, ব্রাহ্মণ সেবধিঃ, বজ্রসূচি ইত্যাদি।
৫. সংবাদপত্র প্রকাশনা : রামমোহন রায় সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত সূচনা করেন। ড.বিপান চন্দ্রের মতে, “রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার-অগ্রদূত”। তিনি বাংলা, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় বেশ কতগুলি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এবং ফারসি ভাষায় প্রকাশিত ‘মিরাৎ-উল- আখবর’ প্রভৃতি।
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার :
১. জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা : রামমোহন হিন্দু জাতির জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ‘বজ্রসূচি’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন যে-জাতিভেদ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে বিভিন্ন বই রচনা করেন।
২. সতীদাহ প্রথা নিবারণ : তৎকালীন হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে একই সাথে আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। এই অমানবিক কুপ্রথা “সতীদাহ প্রথা” নামে পরিচিত। আগুনে পুড়তে থাকা বধুটির মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তনাদ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য শ্মশানঘাটে ঢাকঢোল-কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে একদল মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে নাচ করত। এই কুপ্রথার বিরোধিতা করে রামমোহন জনমত গড়ার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান।
রাজা রামমোহন বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের কাছে ৩০০ জনের স্বক্ষর বিশিষ্ট সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে এই প্রথা বন্ধের আর্জি জানান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ ডিসেম্বর ১৭নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেন। ড.দিলীপ কুমার বিশ্বাস তাঁর “রামমোহন সমীক্ষা” গ্রন্থে লিখেছেন যে, “সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে হিন্দুজাতির আন্দোলনের মাধ্যমে চেতনার সঞ্চার করা রামমোহনের মহৎ কীর্তি ছিল।”
৩. নারীদের কল্যাণ : রামমোহন উপলব্ধি করেন যে, নারীদের অবস্থার উন্নতি না হলে সমাজের সার্বিক উন্নতি কখনো সম্ভব হবে না। এজন্য তিনি নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্ৰহন করেন।
১) তিনি নানা ধরনের শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে।
২) তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়।
৩) কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপ থেকে নারীসমাজকে রক্ষার জন্য তিনি প্রয়াস চালান।
৪) নারীর বিবাহ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান।
৪. অন্যান্য সামাজিক সংস্কার : রামমোহন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্যপ্রথা, কন্যাপণ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এসব কুপ্রথা গুলির বিরুদ্ধে তিনি নানা সংবাদপত্র ও পুস্তিকার মাধ্যমে প্রচার চালান। রামমোহন নারীপুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর হন।
মূল্যায়ন : পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে যথাযথ প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও রাজা রামমোহন রায়ের চরিত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ করা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি জাতিভেদপ্রথা বা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে রুখে দাঁড়াননি। তিনি নিজে উপবীত ত্যাগ করেননি। ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগের ছলে তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব সমালোচনা সত্ত্বেও আধুনিক ভারত রচনার তাঁর অবদান অপরিসীম।
ড.পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাঁকে “আধুনিক ভারতের-স্রষ্টা” বলে অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “রামমোহন রায় ভারত ইতিহাসে আধুনিক-যুগের সূচনা করেন।” তাই তিনি তাঁকে ‘ভারত পথিক’ বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস তাঁকে ‘বিশ্ব পথিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন।