সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজকের এই পর্ব আপনাদের সাথে শেয়ার করা হলো রামমোহন রায়ের পরবর্তী কালে ব্রাহ্ম অগ্ৰগতি সম্পর্কে।
রামমোহন রায়ের পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম আন্দোলন :
রামমোহন রায় মারা যাওয়ার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তার পরবর্তীসময়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর পরে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনকে নতুন দিশা দেখায়। রামমোহন রায়ের পরবর্তীসময়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের আমলে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত নীচে আলোচনা সাপেক্ষ-
১. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অলমে : রাজা রামমোহন রায়ের মরণের পর তাঁর অন্যতম সুহৃদ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর দায়িত্ব নিলে ব্রাহ্ম আন্দোলন আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি নানা সক্রিয় উদ্যোগ গ্ৰহণের মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেন। তিনি নানা প্রকার রীতিনীতি ও নিয়মকানুন শুরু করে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি সুসংগঠিত ধর্মীয় রূপ দান করেন। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দোগ নেন। তাঁর উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ শিক্ষাবিস্তার এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্যোগ নেয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কার নিবারণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
২. কেশবচন্দ্র সেনের আমলে : কেশবচন্দ্র সেন ১৮৫৬ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অধীনে ব্রাহ্মসমাজে অংশগ্রহণ করলে ব্রাহ্ম আন্দোলনে তীব্র গতিতে অগ্ৰসর হয়। কেশবচন্দ্রের ভাবাদর্শ,নারীমুক্তি শিক্ষাবিস্তার, সমাজসংস্কার এবং সমাজসেবার আদর্শ, ধর্মোন্মাদনা এবং ব্যক্তিগত অংশে বহু শিক্ষিত যুবক ব্রাহ্মসমাজে অংশ নেয়। এই আন্দোলনে কেশবচন্দ্রের সফল নেতৃত্বদানের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেন এবং ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক ও আচার্য পদে নিযুক্ত করে।
1. কেশবচন্দ্রের বিভিন্ন কর্মউদ্যোগ : কেশবচন্দ্র সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কর্মউদ্যোগ গুলি ছিল-
i. বিভিন্ন সমাজসংস্কার উদ্যোগ : কেশবচন্দ্রসেন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে এবং নারীশিক্ষা,বিধবাবিবাহ, নারীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, শ্রমিক-কল্যাণ প্রভৃতির সমর্থনে দেশে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ii. বিভিন্ন সাংগঠনিক উদ্যোগ : কেশবচন্দ্রের উদ্যোগে অনেক সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮৬০ এর ‘ব্রাহ্মবন্ধু সভা’ ও ‘সংগত সভা’, ১৮৬২ তে ‘ক্যালকাটা কলেজ’ প্রভৃতি। নারীকল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি ‘বামাবোধিনী সভা’, এবং ‘ব্রাত্মিকা সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। কেশবচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি হল ১৮৬১ সালে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার প্রকাশ।
2. বাংলার বাইরে বিভিন্ন কর্মউদ্যোগ : কেশবচন্দ্রসেন বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে ব্রাহ্মধর্ম ও সংস্কার আন্দোলনের প্রসার ঘটান। সমগ্ৰ দেশে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ছিল মাত্র পাঁচশো জন। কিন্তু ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজারে । ঐতিহাসিক ড.রমেশচন্দ্রের মত অনুসারে, কেশবচন্দ্রের সংস্কার আন্দোলনই হল ‘প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন’।
3. মতানৈক্য এবং কেশবচন্দ্রকে বহিষ্কার : নানা রকম ঘটনাকে কেন্দ্র করে শীঘ্রই কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন তরুণ ব্রাহ্মদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বচসা বাধে।
i) দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুরের আদর্শ : একেশ্বরবাদী হলেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ব্রাহ্মধর্ম হলই হিন্দুধর্মই। এজন্য তিনি মূর্তিপূজা ছাড়া জাতিভেদ সহ অন্যান্য প্রথাগুলির বিরুদ্ধে বিরোধ করলেও, সমাজসংস্কারকে ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে লিপ্ত করতে সম্মত ছিলেন না একেবারে।
ii) কেশবচন্দ্র সেনের আদর্শ : কেশবচন্দ্র সেন এবং তাঁর অনুগামীদের কাছে ব্রাহ্মধর্ম হল সমন্বয়ী এবং সর্বজনীন। কেবলমাত্র পৌত্তলিকতাই না, তাঁরা একই সঙ্গে জাতিভেদ ও নানান সামাজিক কুপ্রথার বিরোধী ছিলেন। তাঁদের কাছে ব্রাহ্মধর্ম নিছক ধর্মীয় আন্দোলন নয়, সমাজসংস্কারও তার অঙ্গীভূত।
iii) বিভাজননীতি : অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রপাঠ, ব্রাহ্ম আচার্যদের উপবীত ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে তরুণ ব্রাহ্মরা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ জনালে দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীদের ব্রাহ্মসমাজ থেকে বহিষ্কার করেন। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন বহিষ্কৃত ব্রাহ্মরা ১৮৬৬ সালে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি-ব্রাহ্মসমাজ’ নামে আখ্যায়িত হয়।
৩. ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের কর্মসূচি : কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ গঠন করে ব্রাহ্ম আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
i) নানা সমাজসংস্কার উদ্যোগ : ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা, প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, সুলভ সাহিত্য প্রচার, নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির পক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিভিন্ন পতিতা পল্লির মেয়েদের উদ্ধার, ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার মাধ্যমে ব্রাহ্ম আদর্শের প্রচার এই সব বিষয়েও তারা উদ্যোগ নেয়।
i) কমবয়সী সদস্য : কেশবচন্দ্রের আন্দোলনে যেসব অল্পবয়সী সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শিবনাথ শাস্ত্রী,দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রামকুমার বিদ্যারত্ন, শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
৪. ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে বিভাজন : কেশবচন্দ্র সেনের কিছু উদ্যোগকে লক্ষ্য করে অল্পদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে ভাঙন সৃষ্টি হয়।
i) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ : শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি কমবয়সী ব্রাহ্ম কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতি, গুরুবাদের প্রতি আসক্তি, নিজ নাবালিকা কন্যার বিবাহ দান প্রভৃতি ঘটনার প্রতি কঠোর প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা শেষপর্যন্ত কেশবচন্দ্রের সঙ্গ ত্যাগ করে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ii) নববিধান ব্রাহত্মসমাজ : পৃথক সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত পরবর্তীতে কেশবচন্দ্র ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শে তাঁর ‘নববিধান’ ঘোষণা করেন। তখন থেকে তাঁর শাসনাকৃত ব্রাহ্মসমাজ ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়। এই সমাজ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব এর পরও অব্যাহত থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাজা রামমোহনের পরবর্তীসময়েও ভারতের সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্ব অসামান্য ছিল। এই গুরুত্বগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল-
i. বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মদগ্ৰহণ, জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা, পর্দাপ্রথা ইত্যাদির বিরোধিতা করে ব্রাহ্মসমাজ নারীস্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বিধবা বিবাহ, শিক্ষার উন্নয়ন, হরিজন উন্নয়ন প্রভৃতির সপক্ষে কার্য চলতে থাকে।
ii. ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের কারণে সরকার কতৃপক্ষ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘তিন আইন’ পাস করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে।
iii. বিভিন্ন দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা ঘোচানোর লক্ষ্যে ব্রাহ্মসমাজ বিভিন্ন পদক্ষেপে অংশ নেয়।
iv. ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্য প্রভৃতির আদর্শ প্রচার করে ব্রাহ্মসমাজ গণতান্ত্রিক বিকাশে পৌঁছে যায়।
আরও নজর রাখতে ভুলবেন না : |