ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল

সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পাঠটিতে শেয়ার করলাম ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে। আসুন প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ গুলি।

ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল

◆ ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ :

ভূমিকা : আঠারো শতকে আবদুল ওয়াহাব [ 1703-92 খ্রি.] নামে এক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা ‘ ওয়াহাবি আন্দোলন ’ নামে পরিচিত। আরবের অনুকরণে উনিশ শতকে বাংলায় তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল। সেই কারণ গুলি হলো-

1. ইসলামের শুদ্ধিকরণ : তিতুমির মনে করতেন , বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামধর্মে বহু কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। এজন্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে ইসলামকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিতুমির শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন।

2. খাজনা আদায়ে অত্যাচার : প্রথম জীবনে তিতুমির বিভিন্ন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করতেন। এই সময় তিনি খাজনা আদায়ের জন্য দরিদ্র কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেন।

3. সংগঠন প্রতিষ্ঠা : তিতুমির জমিদার , মহাজন ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেধে যায়।

4. কৃষ্ণদেব রায়ের অত্যাচার : গুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে , কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। এতে তিতুমিরের অনুগামীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।

মূল‍্যায়ন : ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ইংরেজ ও তার পৃষ্ঠপোষক জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ মুসলিমদের সশস্ত্র প্রতিবাদ। তাদের সঙ্গে হিন্দু কৃষকরা যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

◆ ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল :

ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের নেতৃত্বে একসঙ্গে বিদেশি ইংরেজ শাসন এবং দেশের জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। ড . শশীভূষণ চৌধুরীর মতে , “ এই আন্দোলন ছিল জমিদার – বিরোধী ও ব্রিটিশ সরকার – বিরোধী গণসংগ্রাম। ”

1. জমিদারদের বিরোধিতা : বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল পুঁড়ার জমিদার কৃয়দেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। তিতুমির হিন্দু – মুসলিম উভয় শ্রেণির জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই ড . বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন , “ তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের বিরুদ্ধে। ”

2. ব্রিটিশবিরোধিতা : বারাসাত বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হলেও শেষপর্যন্ত তা ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়। বারাসাত – বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে তিতুমির নিজেকে ‘ বাদশাহ ’ বলে ঘোষণা করেন। ড . শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে , “ এই আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশবিরোধী। ”

3. কৃষক ঐক্য : ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষক ঐক্যের একটি মূর্ত প্রতীক। মুসলিম কৃষকরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। ড . বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন , “ এই বিদ্রোহ হল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষকবিদ্রোহ। ”

4. নিম্নবর্গের শ্রেণিসংগ্রাম : তিতুমিরের ডাকে সমাজের নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ বারাসাত বিদ্রোহে শামিল হয়। বহু দরিদ্র হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।

মূল‍্যায়ন : ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিতুমির দরিদ্র , সাধারণ কৃষকদের রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় আনতে সক্ষম হন। ড . রণজিৎ গুহও মনে করেন যে , ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই।

◆ বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি :

ভূমিকা : বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে সংঘটিত ওয়াহাবি আন্দোলন বা বারাসাত বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি কী ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। যেমন-

1. ধর্মীয় আন্দোলন : ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার , বিহারীলাল সরকার , কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ বারাসাত বিদ্রোহের মধ্যে ‘ সাম্প্রদায়িক ‘ অর্থাৎ ধর্মীয় চরিত্র দেখতে পেয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে , এই আন্দোলন ছিল ‘ ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড ’ এবং হিন্দু বিরোধী। ড . ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন যে , এই বিদ্রোহ ছিল ‘ হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত আক্রমণ।

2. অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন : কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ ইসলামি উন্মাদনা দেখতে পাননি। তাই হান্টার , থর্নটন প্রমুখ মনে করেন যে , এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক।

3. শোষণের বিরোধিতা : নরহরি কবিরাজ , ড . কেয়ামুদ্দিন আহমদ প্রমুখ মনে করেন , বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অত্যাচারী জমিদার ,নীলকর ও ব্রিটিশ – বিরোধী এক আন্দোলন। শোষণ ও অত্যাচারের বিরোধিতাই ছিল বিদ্রোহের মূল কথা।

4. কৃষকবিদ্রোহ : ওয়াহাবি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা মুসলিম কৃষক হলেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। তাই অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরীর মতে , “ ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন।

মূল‍্যায়ন : মূলত কৃষক আন্দোলন হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের ধর্মীয় চরিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থনৈতিক জীবনের সাথে জড়িত ও ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় ঠিকই , তবে এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ কৃষক আন্দোলনগুলির পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।

আরও পড়ুন :

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশ্ন উত্তর 

মেকলে মিনিট কি ?

 

Leave a Comment