সুপ্রিয় বন্ধুরা আজকের এই পর্বে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম নানা রূপে সুন্দর : ঊর্বশী বিজয়িনী ও আবেদন সম্পর্কে।
নানা রূপে সুন্দর – ঊর্বশী বিজয়িনী ও আবেদন :
রবীন্দ্রনাথ অন্তত ‘চিত্রা‘ রচনার পর্বে বিশস্ত ছিলেন এই ধারণার প্রতি যে, নিখিল বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্যের মূলে আছে এক চিরন্তন সৌন্দর্যময়ী নারী, যে বস্তু নিরপেক্ষ এবং রূপাতীত। ‘মানসী’ থেকে ‘সোনার তরী’র মধ্য দিয়ে যে অপার্থিব প্রেম ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধান চলছিল কবির, তারই ব্যাপ্ত পরিণতি “চিত্রা’য়।
কবি এখন জানেন জীবনের সত্যকার প্রেম ও আনন্দের স্বাদ লভ্য বিশুদ্ধ অখণ্ড অপরূপ ভাবনার স্তরে। যদিও “চিত্রা” কাব্য কেবলই অমর্তচারী নয়, কেবলই শূন্যে শূন্যে তার সঞ্চরণ নয় এই মাটির দিকে, মানুষের দিকে প্রায়ই তার অবতরণ ঘটেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই স্থির বিশ্বাসের অবিচল ছিলেন যে, সৌন্দর্যের আদি রূপ বস্তু নিরপেক্ষ এবং ইন্দ্রিয়জ ভোগের অতীত এক ধারণা মাত্র। এইরকম রূপহীন রূপ দেখি ঊর্বশীতে, সেই বিজয়িনী নারীতে মদন যাঁর কাছে পরাজিত কিংবা মানুষ যাঁর মালঞ্চের শুধু মালাকর হতে চায় সেই মহিমাময়ী মহেশ্বরীর চরণে। আসলে সৌন্দর্যের একই চেতনা থেকে “চিত্রা”র এই তিনটি কবিতা “উর্বশী’, ‘বিজয়িনী’, ‘আবেদন’ জন্ম নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসৌন্দর্যের আদিতে যে নারীকে অনুভব করেছেন তাকে নানা সাজে সজ্জিতা করে তিনটি কবিতাতেই তার বিভিন্ন রূপ বর্ণনা করেছেন। তবু তা রয়ে গেল আমাদের প্রত্যহের ম্লান স্পর্শের বাইরে। সেই নারী পার্থিবের সমস্ত অভ্যস্ততার উর্দ্ধে-কেবল অনুভবে তাকে পাওয়া যায়।
পড়ুন : চিত্রা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য মনস্কতা : বিজয়নী ও অন্যান্য
তাঁর প্রার্থিত দেবীকে যিনি পুজায় চেয়েছেন, প্রেমে নয় সেই কবি তাঁর “জীবন সর্বস্বধন” অর্পণ করেছেন রানীর পায়ে এই রানী বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সকল লৌকিক প্রয়োজনের বাইরে কেবলমাত্র সেবাতেই এই পূর্ণ রূপ যৌবনা দেবীর প্রতি কবির অন্তরের পূজা।
কবির কাজ স্বার্থবন্ধনহীন, বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য আহরণ করে মালা রচনা করে দেবীর পূজাই তার শ্রেষ্ঠ পূজা। এর কোনও লৌকিক মূল নেই, আছে, কেবল “শত শত আনন্দের আয়োজন’। আর “আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’-এ প্রার্থনা সেই সৌন্দর্যব্যাকুল কবি প্রেমিকের যে বৈষ্ণবীয় দাস্যরসের অনুগামী।
“বিজয়িনী” কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যপ্রিয়তার অন্যতম চরম নিদর্শন পাখা মেলেছে নানা রঙের বিভায়। সৌন্দর্য সম্পর্কে একটা দিব্য চেতনা এসেছে এই পর্বে কবির মনে যা কোনও প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে, যা অপরূপ দেহ বর্ণনার সময়ও কাম চেতনার উদ্ভব করে না। এই অলৌকিক সৌন্দর্যানুভূতির কথাই “চিত্রা” কাব্যের মূল কথা যা ব্যক্ত হয়েছে “ঊর্বশী” এবং “বিজয়িনী’ কবিতায়।
‘বিজয়িনী’ এবং ‘উর্বশী’ কবিতায় কবি সৌন্দর্যকে অনুভব করেছেন সমস্ত মানবসম্বন্ধের বিকার থেকে, প্রয়োজনের সীমা থেকে দূরে এক বিশুদ্ধ অখণ্ডতার মধ্যে। সকল সৌন্দর্যের আদর্শ নারীর রূপসৃষ্টিতে যাকিছু কাব্যরস সমস্তই লভ্য এই বক্তব্যকেআদর্শ করেই যেন ‘বিজয়িনী’ কবিতা রচিত। নারীকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসৌন্দর্যের প্রতীক রূপে দেখেছেন। তাঁর “মানস সুন্দরীকে”, তাঁর অনন্তরূপযৌবনা ঊর্বশীকে আবার দেখি অপূর্ব ক্রীড়াময়ী নারী রূপে বিজয়িনী কবিতায়।
দীর্ঘকাল ধরে কবিচিত্তে সৌন্দর্যের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়মোহ মিশ্রিত ছিল সেই মোহমুক্তির তাত্ত্বিক দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে এই “বিজয়িনী” কবিতায়। নারীদেহের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রকাশ, তাকে ভোগ করবার জন্য পুরুষের কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু নারীর সেই দৈহিক সৌন্দর্যের মধ্যে এক চিরন্তন নিত্য সৌন্দর্য আছে যা শাশ্বত, পবিত্র, স্বর্গীয়-তাকে ভোগের দ্বারা লাভ করা যায় না। সেই অপার্থিব সৌন্দর্য-স্বরূপা দেবীকে লাভ করা যায় পূজায়। মদনের পঞ্চশর সেখানে ব্যর্থ। এই শাশ্বত দেবী সর্বত্র বিজয়িনী।
বিজয়িনী’ কবিতায় আগাগোড়াই সৌন্দর্য স্নাত। বসন্তের মধ্যাহ্নে সুন্দরী রসনীয় স্নানদৃশ্য, স্খলিত বসন, দর্পণ, নূপুর, বকুলের ছায়া, শ্বেত রাজহংসী এবং কপোত দম্পতির চিত্রকল্প সর্বত্রই সুন্দর তার হস্তচিহ্ন স্থাপন করেছিল। সর্বত্র সব আয়োজন পূর্ণ ছিল “বসন্ত পরশে/পূর্ণ ছিল বনচ্ছায়া আলসে লালনে’- তারপর স্নানোত্থিতা রমণীর স্খলিত কেশ এবং সৌন্দর্যের স্বর্ণচূড়া দেখা গেল যখন মধ্যাহ্ন সূর্যের রশ্মিরেখা এসে চুম্বন করল রমণীর অনাবৃত উরু, কটিদেশ, স্তন, বাহুযুগল।
সূর্য সে সৌন্দর্যের বন্দনা করল, বাতাস বন্দনা করল, সমস্ত বনস্থল স্তব্ধ বিস্ময়ে অবনত। সর্বপোরি এই সৌন্দর্যের উপরে ছিল লাবণ্য। যৌবনের উচ্ছল তরঙ্গ লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে যেন স্থির হয়েছে। দেহের শিখরে শিখরে মধ্যাহ্নরৌদ্র যে দীপ্তি এনেছিল তাকে স্নিগ্ধ শান্ত সৌন্দর্যে সমাহিত করেছে অনন্ত আকাশ এবং বাতাস। অতএব সৌন্দর্যের স্থির সরোবরে প্রণয়বেগ কোনও চাঞ্চল্য জাগাতে পারেনি। অতএব নায়কবিহীনা নায়িকার কাছে মদনদেব সহজেই পরাজিত হয়েছেন।
কিন্তু ঊর্বশী যুগ যুগ ধরে মানুষের চিত্তে কামনার সঞ্চার করেছে মুনিরও চিত্তবিকার ঘটিয়েছে। ঊর্বশী নর্তকী, তার এক হাতে সুধাভাণ্ড অন্যহাতে বিষপাত্র। কিন্তু এই বিজয়িনী নারীকে নর্তকী রূপে কল্পনা করা যায় না যেমন, তেমনি অনায়াসে বলা যায় তাঁর কোন হাতেই বিষপাত্র নেই। যদিও ‘ঊর্বশী’ এবং ‘বিজয়িনী’ কবির সৌন্দর্যের ব্যাকুলতার একই রূপ কিম্বা অপরূপ মূর্তি-দুই এর তফাৎ। আসলে যে স্নিগ্ধতার আবেশ বিজয়িনীতে পাওয়া যায় ঊর্বশীতে তা নেই। ঊর্বশীর কেবল দ্যুতি “বিজয়িনী”র আছে লাবণ্য।
পড়ুন : চিত্রা নামকরণে ছবির ইশারা
বলাকার ‘দুই নারী’ কবিতায় উর্বশী এবং বিজয়িনীর স্পষ্ট রূপ আবার পাওয়া যায়-
“এক জনা-ঊর্বশী সুন্দরী
বিশ্বের কামনা রাজ্যের নারী
স্বর্গের অপ্সরী
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী
বিশ্বের জননী তারে জানি
স্বর্গের ঈশ্বরী।
দুইজনেই অলভ্য-সমস্ত প্রাত্যহিকতার, সমস্ত রূপের, সমস্ত মর্ত্যতার উর্ধ্বে।
‘ঊর্বশী’ও ‘বিজয়িনী’ উভয় কবিতাতেই প্রাচীন চিত্রকল্প ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। কালিদাস এবং বানভট্টের অনুসরণ রয়েছে বিজয়িনী কবিতায়, আর সমস্ত ‘উর্বশী’ কবিতার মধ্যে প্রাচীন আবহ সঞ্চারিত।
‘বিজয়িনী কবিতার মধ্যাহ্ন কপোত দম্পতির চঞ্চু-চুম্বন কালিদাসকে স্মরণে আনে।
রমণীর পোষাক, দর্পণ, নূপুর, প্রসাধনদ্রব্য, শ্বেত শিলাতল, শ্বেত রাজবংশ কোথাও বর্তমানের হস্তীচিহ্ন নেই। আর বসন্ত সখা অনঙ্গদেব পুষ্পবাণ হাতে বকুলের তলে পুষ্পাসনে বসে আছেন। এই দৃশ্য দূর অতীতের, আমাদের অভ্যস্ত মর্ততার অনেক দূরের।
আর রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ ‘ঊর্বশী’ কল্পনাই পৌরাণিক কাহিনির আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। ঊর্বশীর সৌন্দর্য, তার জীবন ইতিহাস, তার বন্ধনহীন সৌন্দর্যবিলাস পুরাণ এবং কালিদাসের ‘বিক্রোমোর্বশীয়’ নাটক মারফৎ রবীন্দ্রনাথের পরিচিত ছিল। তাকে নতুন রূপ -্চেতনায় এবার কবি অনুভব করলেও পুরাতন পটভূমির এক শাশ্বত রূপ ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। ঊর্বশী মানবমন মন্থনজাত, সুরসভার নর্তকী, ছন্দাতীত তার জীবনের ক্রমবিকাশ, ত্রিভুবন তার রূপমুগ্ধ তবুও প্রকৃত স্বরূপ তার অজানা।
পৃথিবীর আদিযুগ ঊর্বশীর জন্য জগতে বাসনা উদ্দাম হয়েছিল। তারপরে মোহভঙ্গ হয়েছে নিদারুণ প্রত্যাখ্যানে। অতএব ঊর্বশীর সেই গৌরবযুগ আজ অস্তমিত “তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে”। কোনোদিন হয়তো দূর অতীত থেকে সুদূর ভাবীকালে আবার উত্তরণ ঘটবে।