পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্ৰহনে ভারতের মধ‍্যবিত্ত শ্রেণির উদ‍্যোগ ও তাৎপর্য

সুপ্রিয় বন্ধুরা, আজকের এই পর্বটিতে আলোচনা করলাম পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্ৰহনে ভারতের মধ‍্যবিত্ত শ্রেণির উদ‍্যোগ ও তাৎপর্য সম্পর্কে।

পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্ৰহনে ভারতের মধ‍্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ :

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথমার্ধে পাঠশালা, টোল, মাদ্রাসা, মক্তব ইত্যাদি শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাচীন শিক্ষাদান প্রথা চলত। পরবর্তীতে খ্রিস্টান মিশনারি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তির চেষ্টায় ভারতে অনেক শিক্ষাকেন্দ্র গঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা দান করা হত। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাঅর্জনে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়।

১. বিভিন্ন অফিস আদালতের স্থাপন : ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সরকার এদেশে প্রচুর অফিস-আদালত স্থাপন করে। এসব অফিসের উচ্চপদগুলি ব্রিটিশদের জন্য সংরক্ষিত হলেও নীচু পদগুলিতে প্রচুর সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত কর্মচারীর দরকার হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এসব অফিস-আদালতে সরকারি চাকরির আশায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে উৎযোগী হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষার আদর্শে তারা পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে ওঠে।

২. ব্রিটিশ অনুরাগী : ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাঅর্জনকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজ সরকারের সহযোগী ও সমর্থকে পরিণত হয়। প্রথমদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগই ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে আশীর্বাদ বলেই মনে করতেন। পাশ্চাত্য শিক্ষাঅর্জন কারী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। ডিরোজিও-র অনুগামী রামগোপাল ঘোষ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্বকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।

৩. চাকরিতে অগ্রাধিকার : সরকারি চাকরিই ছিল ঔপনিবেশিক আমলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভারতীয়দের প্রধান পেশা। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা দেয় যে, চাকরির জন‍্য ইংরেজি জানা প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই ঘোষণার ফলে চাকরি পাওয়ার আশায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির পড়ুয়ারা আরও বেশি করে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়।

৪. মধ্যবিত্তদের উৎযোগ : পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে অন‍্যতম ছিলেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁরা অনেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন‍্য বেশ কটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। রামমোহন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি চিঠি লেখেন। তাঁর এই চিঠি ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসে একটি অন‍্যতম মূল্যবান দলিল।

পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্ৰহনে ভারতের মধ‍্যবিত্ত শ্রেণির তাৎপর্য :

ব্রিটিশ শাসনে ভারতের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে তারা খুবই সামান্য ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় জনজীবনে পাশ্চাত্য শিক্ষার গভীর প্রভাব পড়ে।পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্ৰহনে ভারতের মধ‍্যবিত্ত শ্রেণির তাৎপর্য গুলি হল-

১. পাশ্চাত্য ডাবধারার প্রভাব : ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কারণে তারা সমাজজীবনে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মমর্যাদা পায়। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সভ্যতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, মানবতাবাদ, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিতরাই ভারতীয় সমাজে এসব ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়।

২. জাতীয়তাবাদী সাহিত্য : পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনায় উদ্যোগী হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটে। তা ছাড়া জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভাষায় বহু সাহিত্য রচিত হতে থাকে।

৩. জাতীয় ঐক্য : মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার লাভের ফলে ভারতের নানা প্রান্তের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য সংগঠিত হয়। ইংরেজি ভাষা তারই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দ এর ফলে ভারতের জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী ও সচেতন হয়ে ওঠেন। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

৪. জাতীয় আন্দোলন : প্রথমভাগে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীসময়ে তারাই ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্বে সামিল হয়। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

৫. প্রগতিশীলতা : মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ করার ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পটভূমি রচিত হয়।

৬. নবজাগরণ : মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ‍্যদিয়ে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেকে উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে। কারো কারো মতে বাংলায় উনিশ শতকের নবজাগরণকে পঞ্চদশ শতকের ইতালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মূল‍্যায়ন : ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রগতিশীল মনোভাবে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেও তারা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার খুবই সামান্য অংশ মাত্র। তা সত্ত্বেও শত- সহস্র নক্ষত্রের মধ্যে চাঁদ যেমন মধ্যমণি হিসেবে অবস্থান করে তেমনি উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ভারতীয় সমাজজীবনে মধ্যমণি হিসেবে সমাজকে আলোকিত করেছিল। A. R. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে শহরের উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়ে গঠিত এই শ্রেণির প্রগতিশীলতার সঙ্গে গ্রামীণ ভারতের সাধারণ মানুষের যোগসুত্র ছিল খুবই অতি সামান্য।

আরও নজর রাখুন :

ভারতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

Leave a Comment