ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

সুপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রী বন্ধুরা আজকের এই পরবর্তীতে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আশা করছি তোমাদের এই আলোচনাটি অবশ্যই ভালো লাগবে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ :

ভূমিকা : স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এদেশের সর্বশেষ বৃহত্তম ব্রিটিশ – বিরোধী আন্দোলন। গান্ধিজির নেতৃত্বে 1942 খ্রিস্টাব্দে 8 আগস্ট কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আন্দোলনকে শুরুতেই দমনের উদ্দেশ্যে সরকার 9 আগস্ট ভোরে বোম্বাই স্টেশন থেকে কংগ্রেসের প্রথম শ্রেণির প্রায় সকল নেতাদের গ্রেফতার করলে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার, সরকারের দক্ষিণ – পূর্ব এশীয় নীতি , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বেকারত্ব , দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি , খাদ্য সংকট প্রভৃতি এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ গুলি হলো :

1. ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা : 1939 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রথম শ্রেণির নেতাদের সঙ্গে আলাপ – আলোচনার উদ্দেশ্যে 1942 খ্রিস্টাব্দে ( 29 মার্চ ) ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধি দল বা ‘ ক্রিপস মিশন ’ জানায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতকে ‘ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস ’ বা স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু গান্ধিজি পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তিনি এই প্রস্তাবটিকে “ ফেল পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক ” বলে প্রত্যাখ্যান করেন।

2. ভারতের দিকে জাপানের অগ্রগতি : ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তাই জাপান দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর মিত্রজোটকে পরাজিত করে ভারতের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করেন।

3. গান্ধিজির ভূমিকা : 1939 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গান্ধিজি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, এটিই ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আদর্শ সময়। এজন্য তিনি 1942 খ্রিস্টাব্দের 8 আগস্ট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ Do or Die’- এর ডাক দেন।

4. সেনাদের ওপর অত্যাচার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যদের দূরদেশে বিপদসংকুল যুদ্ধক্ষেত্রগুলিতে পাঠানো হয়। নিয়মিত বেতন না পাওয়া, এই পদে কর্মরত শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদের চেয়ে কম বেতন পাওয়া, অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ , শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার প্রভৃতি ছিল ভারতীয় সেনাদের নিত্যসঙ্গী। বহু ভারতীয় সৈন্যের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কখনও পদোন্নতি বা উচ্চপদে নিয়োগের সুযোগ ছিল না। এইসব ঘটনা ভারতীয়দের ক্ষুদ্ধ করেছিল।

5. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের জন্য ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ খাবার পাঠানো হতে থাকে। এর ফলে ভারতে খাদ্যদ্রব্য – সহ অন্যান্য পণ্যের মূল্যও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। মূল্যবৃদ্ধি ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে।

6. কৃষকশ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ : বাংলা, বিহার, আসাম ও উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা ছিল ভূমিহীন, দরিদ্র ও খেত মজুর। তাদের ওপর করের বোঝা, উৎপন্ন ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রভৃতি ঘটনা তাদের ক্ষুব্ধ করে এবং আন্দোলনে উৎসাহ জোগায়।

7. শ্রমিকশ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে ভারতের শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। কিন্তু মালিকশ্রেণি তাদের মজুরি বৃদ্ধি করেনি। বরং যুদ্ধের ডামাডোলে শিল্পপণ্য বিক্রি ব্যাহত হলে কলকারখানাগুলি থেকে বহু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। ফলে ক্ষুব্ধ শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলাফল বা গুরুত্ব :

ভারত ছাড়ো আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের নানা গুরুত্ব ছিল সেগুলি হলো-

1. আন্দোলনের ব্যাপ্তি : সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। কৃষক শ্রমিক, নারী – পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সকলের যোগদানের ফলে এটি প্রকৃত অর্থে গণ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে সম্পাদিত ‘ The Indian Nation in 1942 ‘ গ্রন্থে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে।

2. ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রমাণ করে দেয় যে, মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। বড়োেলাট লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন , “ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। পুনরায় এই ধরনের একটি আন্দোলন হলে তা মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই। ”

3. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার : মুসলিম লিগ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর – সহ বহু স্থানের মুসলমানগণ এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল এবং আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করে। ফলে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, এইসময় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।

4. স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন : ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। ড. অম্বাপ্রসাদ বলেছেন , “ 1942 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা 1947 খ্রিস্টাব্দের ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে। ”

5. কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি : ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতানুসারে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে 42 – এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়।

মূল‍্যায়ন : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এক ব্যাপক আন্দোলন। এই আন্দোলনকে সামনে রেখে দেশপ্রেমিক ভারতবাসী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বড়োলাট লিনলিথগো বলেছেন , “ 1857 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে এত বড়ো বিদ্রোহ আর হয়নি। ” এই আন্দোলন 1947 – এর স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।

আরও পড়ুন :

বিপ্লবী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের অবদান ?

ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জিকে প্রশ্নোত্তর

জীববৈচিত্র্য কাকে বলে ? জীব বৈচিত্রের শ্রেণীবিভাগ ?

Leave a Comment