বন্ধুরা, আজকের এই পর্বে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন :
ভূমিকা : বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ভারতের ব্রিটিশ – বিরোধী আন্দোলনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময় বিভিন্ন গুপ্তসমিতির প্রতিষ্ঠা, বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু হয়।
1. অনুশীলন সমিতি : বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসারের ক্ষেত্রে অনুশীলন সমিতি সর্বপ্রথম গুরুদায়িত্ব নেয়। বিপ্লবী সতীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র এর সহায়তায় 1902 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মদন মিত্র লেনে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে সদস্যদের কুস্তি, চরিত্রগঠন, শরীরচর্চা প্রভৃতির সঙ্গে গোপনে চলত বিপ্লবী কাজকর্ম। অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ প্রমুখ এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ – বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ঢাকা, রাজশাহি, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর প্রভৃতি জেলায় এই সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের উদ্যোগে ঢাকার অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
2. কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা : যুগান্তর দলের সদস্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি কলকাতার অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ড মুজফ্ফরপুরে বদলি হয়ে গেলে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল মজফফরপুর চলে যান। সেখানে তাঁরা কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে ভুলবশত বোমার আঘাতে মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা মিস কেনেডি নামে দুজন নিরপরাধ মহিলাকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন। আলিপুর বোমার মামলার রায়ে তাঁর ফাঁসি হয়।
3. যুগান্তর দল ও অন্যান্য সমিতি : বিপ্লবী ভাবধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে বারীন ঘোষ ও উপেন্দ্রনাথ 1906 সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যুগান্তর দল গঠিত হয়। এই দলের সদস্যরা পূর্ববঙ্গ ও আসামের অত্যাচারী ছোটোলাট ব্যামফিল্ড ফুলার ও বাংলার গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। যুগান্তর দলের সদস্যরা ঢাকার প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট মি. অ্যালেনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। যুগান্তর দল ছাড়াও এই সময় বাংলায় আত্মোন্নতি সমিতি, ব্রতী সমিতি, সুহৃদ সমিতি প্রভৃতি বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যায়।
4. ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা : বাংলার বিপ্লবীরা বিভিন্ন অত্যাচারী ব্রিটিশ অফিসার এবং তাদের সহযোগী ভারতীয়দের হত্যার পরিকল্পনা করেন। i. আলিপুর বোমা মামলার সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাস বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হন। ii. ডেপুটি পুলিশ সুপার সামসুল আলম হাইকোর্টেই বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ হারান। ii. ক্ষুদিরাম বসুকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে বিপ্লবীরা পুলিশ অফিসার নন্দলাল ব্যানার্জি কে হত্যা করেন।
5. অলিন্দ যুদ্ধ : বিপ্লবী বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত 1930 সালের 8 ই ডিসেম্বর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে কুখ্যাত কারা অধিকর্তা সিম্পসন নিহত হন। এই ঘটনা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। দীনেশ ও বিনয় এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করে গুলিতে আহত হন। পরে বিনয় হাসপাতালে মারা যান এবং দীনেশের ফাঁসি হয়।
6. বুড়িবালামের যুদ্ধ : সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে বাঘাযতীন জার্মানি থেকে তিনটি অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বাংলায় আনার ব্যবস্থা করেন। উড়িষ্যার বালেশ্বরে আগত মাভেরিক জাহাজের অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাঘাযতীন, নীরেন, চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, জ্যোতিষ প্রমুখ বালেশ্বরে পৌঁছোন। কিন্তু গোপন খবর পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট বিপ্লবীদের ঘিরে ফেললে বুড়িবালাম নদীর তীরে পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে ব্যাপক গুলির লড়াই চলে। চিত্তপ্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে এবং বাঘাযতীন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। বাকি কয়েকজনের ফাঁসি অথবা কারাদণ্ড হয়।
7. ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ : প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে শান্তি চক্রবর্তী, কালীকিঙ্কর দে প্রমুখ সশস্ত্র বিপ্লবীদের একটি দল 1932 সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও পালটা আক্রমণ চালালে গ্রেফতার হওয়ার আগেই প্রীতিলতা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
8. চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন : মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী 1930 সালে 18 এপ্রিল চট্টগ্রামের সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। এই অভিযানে সূর্য সেনের সহযোগী ছিলেন নির্মল সেন, গনেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ বিপ্লবী। লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়ে বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এখানে পুলিশের সঙ্গে তুমুল গুলির লড়াইয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর 70 থেকে 100 জন এবং বিপ্লবীদের 12 জনের মৃত্যু হয়। পরে অবশ্য সূর্য সেন ধরা পড়লে বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
9. অন্যান্যদের ভূমিকা : গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে বিপ্লবী বীণা দাস তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান যদিও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বিপ্লবী কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে বিস্ফোরক এনে আদালতে বিস্ফোরণের উদ্যোগ নেন।
মূল্যায়ন : ভারতের মুক্তি সংগ্রামে বাংলার বিপ্লবীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ একেবারে সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। বিপ্লবী কার্যকলাপ যে ব্রিটিশদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।