সুপ্রিয় বন্ধুরা, আজকের পর্বে আলোচনার বিষয় স্বত্ববিলোপ নীতি কাকে বলে এবং স্বত্ববিলোপ নীতির শর্ত ও প্রয়োগ সম্পর্কে।
স্বপ্তবিলোপ নীতি :
লর্ড ওয়েলেসলির পরবর্তীসময়ে ভারতে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদী শাসক ছিলেন বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি। ঐতিহাসিক sir রিচার্ড টেম্পল মন্তব্য করেছেন যে, “ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মধ্যে ডালহৌসির সমকক্ষ আর অন্য কেউ ছিলেন না।” ঐতিহাসিক ইনেস মন্তব্য করেন, ডালহৌসির পূর্ববর্তী শাসকরা যুদ্ধ বা রাজ্য দখল এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ডালহৌসি ছিল তার উল্টো তিনি সর্বদা রাজ্য দখলের সুযোগ খুঁজতেন। ডালহৌসির আমলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বাধিক প্রসার ঘটে।
স্বপ্তবিলোপ নীতি কাকে বলে :
ভারতের ব্রিটিশ বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি যেসকল নীতি অবলম্বন করে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রবল প্রসার ঘটান সেগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল স্বত্ববিলোপ নীতি। এই নীতি অনুযায়ী তিনি ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলির অপুত্রক রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার নাকাচ করেন। তাই সেই সমস্ত রাজাদের মৃত্যুর পর তার সিংহাসনে উত্তরাধিকারীর স্বত্ব বা অধিকার বিলুপ্ত হত। যার ফলে সেই রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হত।
স্বপ্তবিলোপ নীতির শর্ত :
স্বত্ববিলোপ নীতির মূল শর্ত গুলি হলো –
১. দেশীয় রাজ্যগুলির ভাগ : ডালহৌসি ভারতের দেশীয় হিন্দু রাজ্যগুলিকে সাধারণত তিনভাগে বিভক্ত করেন যথা-
i. কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য।
ii. স্বাধীন দেশীয় রাজ্য।
iii. কোম্পানির আশ্রিত বা অধীনস্থ করদ রাজ্য ।
২. কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট কোনো দেশীয় রাজ্যের রাজার যদি কোনো পুত্রসন্তান না থাকে তাহলে সেই রাজা কোনো উত্তরাধিকারী বা দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী না থাকার কারণে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে।
৩. স্বাধীন দেশীয় রাজ্য : স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির উত্তরাধিকার বিষয়ে সরকার কোনোরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
৪. কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্য : কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্যের রাজারা কোম্পানির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দত্তক সন্তান গ্রহণ করতে পারবে। তবে সেই দেশীয় রাজাকে কোম্পানি যদি দত্তক গ্রহণের অনুমতি না দেয় তাহলে রাজার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীহীন রাজ্যটি কোম্পানির অধিকারে চলে যাবে।
স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ :
লর্ড ডালহৌসির আগে ১৮৩৯ সালে মন্ডাভি, ১৮৪০ সালে কোলাবা ও জলায়ুন এবং ১৮৪২ সালে সুরাটে স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। তবে ভারতে সর্বপ্রথম ডালহৌসিই এই নীতির মাধ্যমে নানা দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং কতগুলি দেশীয় রাজার পদমর্যাদা বাতিল করেন। সেগুলি হল-
১. রাজ্য অধিকার : ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে ১৮৪৮ সালে সাতারা, ১৮৫০ সালে জয়েৎপুর, সম্বলপুর, বাঘাট ও ভগৎ, ১৮৫২ সালে উদয়পুর, ১৮৫৪ সালে করৌলি, ঝাঁসি ও নাগপুর প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
২. রাজার পদমর্যাদা বাদ : স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে ডালহৌসি বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজার পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল করেন। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র নানাসাহেবের বৃত্তি ও পেশোয়া উপাধি বাতিল করা হয়।
অন্যপর্যায়ে ডালহৌসির সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ :
ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ ছাড়াও অন্য কতগুলি উপায়ে ভারতের কতগুলি দেশীয় রাজ্যকে দখল করেন এবং সেখানে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই উপায় বা পন্থাগুলি ছিল –
১. যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্যদখল : ডালহৌসি ১৯৪৯ সালের দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে জয়লাভ করে পাঞ্জাব ও দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধে জয়লাভ করে দক্ষিণ-ব্রহ্ম আরাকান ও তেনাসেরিম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
২. কুশাসনের মাধ্যমে রাজ্য দখল : কুশাসনের মাধ্যমে ডালহৌসি অযোধ্যা রাজ্যটি নিজের দখলে নেন। এ ছাড়াও লর্ড ডালহৌসি অন্যান্য কিছু মাধ্যমে সিকিমের একাংশ ও হায়দ্রাবাদের বেরার প্রদেশটি নিজের দখলে নেন।
মূল্যায়ন : সর্বপরি দেখা যায়, ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে ভারতের সুবিস্তৃত অঞ্চলে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। লর্ড ডালহৌসির ঘোরতর আগ্রাসন শেষ পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের মনে একটা ভয়ের সৃষ্টি করে। এই অসন্তোষের অন্যতম প্রত্যক্ষ ফল ছিল ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরোধী মহাবিদ্রোহে নানা দেশীয় রাজা ও রাজার দত্তক পুত্রদের অংশগ্রহণ।
আরও পড়তে নজর রাখুন : ● পৌরাণিক কাহিনী কাকে বলে এবং বৈশিষ্ট্য ● মুঘল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর |